তিন নক্ষত্রের ভোগান্তি : মোঃ শাহ জামাল

Seba Hot News : সেবা হট নিউজ
0

শিক্ষক ও সমাজসেবী এসএম জুলফিকার আলী (লেবু মাস্টার), সামিউল ইসলাম ও হাসান মাহমুদ রাজা মিয়া রাজনৈতিক মামলা, মিথ্যা অভিযোগ ও হয়রানির শিকার। তাদের সমাজসেবা ও শিক্ষা বিস্তারের সংগ্রামের করুণ ইতিহাস।


তিন নক্ষত্রের ভোগান্তি : মোঃ শাহ জামাল
তিন নক্ষত্রের ভোগান্তি : মোঃ শাহ জামাল


এক

পুরো নাম এস.এম. জুলফিকার আলী। লেবু মাস্টার নামেই বেশি পরিচিত। তিনি মেলান্দহ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকও। বৃক্ষপ্রেমিক হিসাবেও তিনি সর্বাধিক পরিচিত। বিভিন্ন জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকটিক মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী। এক সময় তিনি একটি পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। 

 নিজস্ব অর্থে বৃক্ষ ক্রয় করে বিতরণ করাই তাঁর নেশা। তিনি অসহায়-গরিব ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থী, সুবিধা ও মানবাধিকার বঞ্চিতদের পাশে দাড়াতেন। নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ পাঠাগার।

 বাল্যবিয়ে-মাদক প্রতিরোধ, শিক্ষা বিস্তারসহ সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাÐেও তাঁর অবদান চোখে পড়ার মতো। লেখালেখি, প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার এবং সম্মাননা।

 ২০২০/২০২১ সালের দিকে বাল্যবিয়ে এবং মাদক প্রতিরোধে তৎকালিন জেলা প্রশাসকের সচেতনতামূলক লিফলেট নিজের টাকায় ফটো কপি করেও প্রচার করেছেন লেবু মাস্টার। লেবু মাস্টারের নজরকাড়া সচেতনতামূলক কর্মকাÐের জন্য তৎকালিন জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের কর্তাব্যক্তিগণ ভুয়সী প্রশংসা করেন। শিক্ষা বিস্তার-বাল্যবিয়ে রোধ ও নারীর ক্ষমতায়ন কর্মকাÐের  গণসচেতনতামূলক সমাবেশে যোগদেন তৎকালিন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কবি আব্দুল্লাহ আল মাহামুদ ও  সিনিয়র জেলা তথ্য অফিসার নূরুন্নবী খন্দকারসহ শিক্ষা অফিসের কর্তাব্যক্তিগণ। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লেবু মাস্টার বৃক্ষরোপন অব্যাহত রেখেছেন। ফলদ-বনজ ও বট-পাইকর বৃক্ষরোপনের মধ্যে তিনি আত্মতৃিপ্ত পান। নবদম্পতিকে বৃক্ষ এবং বই উপহার প্রদান লেবু মাস্টারের ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। 

তাঁর বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের ছবিলাপুর গ্রামে। তিনি কাহেতপাড়া-ঘোষেরপাড়া-ছবিলাপুর (কেজিএস) মহর সোবাহান মফিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো-গত ৮ মার্চ একটি রাজনৈতিক মামলায় সন্দেহভাজন আসামী দেখিয়ে জামালপুর কোর্টে সোপর্দ করা হয়। খবরটি মুহুর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হইচই পড়ে যায়। পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাদামনের এই মানুষকে  রাজনৈতিক মামলায় আটক করায় রাজনৈতিক মহলেও চলছে সমালোচনা।

জাতীয় পর্যায়ের প্রথম সারি এবং বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো ছাড়াও জামালপুরের বহুল প্রচারিত আঞ্চলিক পত্রিকা পল্লীকণ্ঠ প্রতিদিনসহ অন্যান্য মিডিয়াতেও এই গ্রেপ্তারের খবরটি ফলাও করে প্রচার করা হয়। 

লেবু মাস্টারের গ্রেপ্তারের বিষয়টি কোনো মহল ভালোভাবে নেয়নি। লেবু মাস্টারকে যে মামলায় সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সেই মামলার বাদীও লেবু মাস্টারকে চিনেন না বলে সাংবাদিকদের জানান। তিনি রাজনীতি করেন কি না? তাও জানেন না-মামলার বাদী। এমনকি লেবু মাস্টারকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো? এই প্রশ্নও সাংবাদিকের কাছে মামলার বাদী  রেখেছেন! গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকরা বাদীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এমন মন্তব্য করেছেন।  

অবশ্য মেলান্দহ থানার অফিসার ইনচার্জ গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে ঘোষেরপাড়া ইউনিয়ন আ’লীগের কমিটিতে সদস্য পদে লেবু মাস্টারের নাম পাওয়া গেছে। কোন নিরীহ  লোক যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে বিস্তর তদন্ত চলছে। 

গ্রেপ্তারকৃত লেবু মাস্টারের ছোটো ভাই পলাশ জানিয়েছেন, আমার ভাই ৪০/৪২ বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষরোপন করে আসছেন। বেতনের টাকায় দুস্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত পাঠাগারটাও পুড়ে দেয়ায় তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। শিক্ষকতার অল্প বেতনের অংশ থেকেও অসহায় মানুষের জন্য খরচ করতেন। তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে কাজ করেছেন।

বিগত দিনে এলাকার কিছু চিহ্নিত দুস্কৃতিকারি স্কুলের ১৬ শতাংশ জমি দখল নিয়ে ঘর নির্মান করে। সেই ঘরে নিজেরা আগুন দিয়ে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল। পরে রেকর্ড সংশোধনী মামলাও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। দুস্কৃতিকারিরা আমার ভাইয়ের নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর মামলার আসামী না হয়েও তাঁর গ্রেপ্তার আমাদের পীড়া দিয়েছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জনৈককে প্রধান অতিথি না করার কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তিনি বিষয়টি সরকার এবং বিএনপি’র নীতি নির্ধারকদের সুনজরে আনতে অনুরোধ করেছেন। 

দুই

অপরদিকে মেলান্দহ উপজেলার চরপলিশা গ্রামের আরেক শিক্ষানুরাগি-মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষক ছামিউল ইসলামেরও পরিণতি প্রায় অভিন্ন। ঝিনাই নদী বহমান ¯্রােতের একটি ধারায় সুশক চলতো। স্থানীয়রা এই সুশককে (শিশুয়া) বলে থাকেন। কালের বিবর্তনে এই সুশক চলাচলের স্থানে পলি জমে ভরাট হলে ঝিনাই নদীও প্রায় বিলীন হয়। এই পলি জমিতে মানুষের বসতিও গড়ে ওঠে। নতুন বসতিকে এবং সুশক (শিশুয়া)’র নামানুসারে শিশুপাড়া বলে সম্বোধন করতেন। আবার কেও কেও নয়াপাড়াও বলতো। ঝিনাই নদীর সুপরিচিত এই স্থানের স্মৃতিচিহ্ন রেখেছে স্কুল। সামিউল ইসলাম দুর্গম এই চরাঞ্চলের শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল। নিজের জমিতে নিজের ঘরের টিনের চালা দিয়ে গড়ে তোলেন শিশুদের জন্য একটি স্কুল। বিনা বেতনে সামিউল শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানসহ গরিব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচও যোগান দিতেন কৃষি নির্ভর সাংসারিক আয় থেকে। 

এ নিয়েও এলাকার কিছু দুস্কৃতিকারি স্কুলের বিরোধীতার জের ধরে সামিউল ইসলাম সীমাহীন নাজেহালের শিকার হন। টানা ১৬ বছরে ১৬ বার ঝড়ের কবলে পড়ে স্কুলটি। ১৬ বারই তিনি স্কুলের ঘর তোলে দেন। যখন ঝড় শুরু হতো শত্রæতাবশত: ছামিউলের স্কুলের চালার বান্ধন কেটে দিতো দুস্কৃতিকারিরা। যাতে ঝড়ে তাড়াতাড়ি স্কুলটি উপড়ে পড়ে। রাতের আধারে স্কুলের টেবিল-চেয়ারে মলমূত্র ছিটিয়ে দিতেও বাদ রাখেনি। শিক্ষা অফিসের জনৈক কর্মকর্তার উপর দায়িত্ব পড়ে স্কুলের মঞ্জুরি এবং এমপিসহ অন্যান্য কাজেও। কাকতালীয়ভাবে ওই কর্মকর্তাও দুস্কৃতিকারিদের স্বজন ছিল। এই সুযোগটি সামিউলের প্রতিপক্ষ হিসেবে দুস্কৃতিকারিদের বড় সহায়ক ছিল। ফলে স্কুলটির রেজিস্ট্রেশন/এমপিও দু’টোতেই ঝামেলা হয়।

এতেই শেষনয়, এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য সামিউল এবং তাঁর ভাই-বোনেরা আরো দু’টি স্কুলসহ কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলেছেন। এই সামিউল সমাজের জন্য কেন এত ভালো কাজ করেন? নিরুত্তর এই প্রশ্নের মাশুল হিসেবে তিনি পেয়েছেন, মিথ্যা মামলা-জমি দখলসহ নানা অত্যাচার। একদিকে স্কুলের করুণ দশা, অপরদিকে ব্যক্তি সামিউল ও তাঁর পরিবারের প্রতি অত্যাচারের খবরাখবর জাতীয়-আঞ্চলিক পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়। 

এই খবরের প্রেক্ষিতে ছামিউল মাস্টার তৎকালের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র আমারদেশের উপসম্পাদকীয়তে সর্বশেষ শিরোনাম হন। হাসান হাফিজুরের লেখা উপসম্পাদকীয়তে সামিউল মাস্টারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার পরামর্শের কথা উল্লেখ করে ব্যাঙ করা হয়। হাসান হাফিজুরের ক্ষোভের ভাষায়, গুনেধরা সমাজে সামিউলরা কেন শিক্ষা বিস্তারে এত ভালো কাজ করলেন? তাও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শামিল। সমাজে ভালো মানুষের বা ভালো কর্মের মুল্যহীনের পরিণতি প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন থেকে যায়।

তিন

গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের সুবাদে, বেশ ক’টি  এনজিও সামিউল মাস্টারের স্কুলের পাশে দাড়ানোর প্রতিশ্রæতিও  রক্ষা করেনি। অবশেষে ইউনাইটেড ট্রাস্ট’র একাডেমিক এডভাইজার আলহাজ ফজলে এলাহীর দৃষ্টিগোচর হয়। পরে ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আলহাজ হাসান মাহমুদ রাজা মিয়াকে জানালে, তিনি অর্ধপাকা একটি ঘর-আসবাবপত্রসহ আনুসাঙ্গিক সার্পোট দেন। ইতোমধ্যেই দুস্কৃতিকারিদের অফিসারের বদলি হয়। পরবর্তীতে স্কুলটি রেজিস্ট্রেশন হয়। শান্তনার বিষয় হলো, বিগত সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী সকল প্রাথমিক স্কুলকে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সামিউলের স্কুলটি জাতীয়করণ হয়েছে। নতুন একটি ভবনও নির্মিত হয়েছে সরকারিভাবে। সরকার এবং সময় সব কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি, সামিউল মাস্টারের। তাঁর এবং পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-জমি দখলও চলমান। বর্তমানে সামিউল স্বপরিবারে নিরাপত্ত¡ার প্রশ্নে নিজ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন, জামালপুর শহরের ভাড়াটে বাসায়।

আরো কষ্টে বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তি উদ্যোগে যে সামিউলের স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসলেন ইউনাইটেড ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আলহাজ হাসান মাহমুদ রাজা মিয়া। গণমাধ্যমে খবরে প্রকাশ, দেশের পটপরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজা মিয়াসহ তাঁর ছেলে-ভাইও রাজনৈতিক মামলার আসামী। রাজা মিয়ার অপরাধ বিগত সরকারের আমলে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। প্রশ্ন জাগে, রাজা মিয়ার মতো বহুজন বিগত অন্যান্য সরকারের আমলেও ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন? পরের সরকারের অধিনেও ব্যবসা বাণিজ্য করবেন। তখনও কি এই অবান্তর প্রশ্ন ওঠবে? বিবেকবানদের প্রশ্ন, রাজা মিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, ট্যাক্স ফাঁকি, দুর্নীতি বা কর্মচারির বেতন না দেয়ার অপরাধে শ্রম আইন কিংবা অবৈধ  কোন কিছুর সাথে জড়িত থাকলে। শান্তনার বাণি হচ্ছে, মামলা হতেই পারে। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তেই প্রমাণিত হবে, দোষ কতটুকু।

রাজা মিয়া মেলান্দহ-মাদারগঞ্জের প্রতিটি গ্রামের মসজিদ ভিত্তিক সমাজের হতদরিদ্র-বিধবা-বৃদ্ধা-এতিমসহ অসংখ্য গৃহহীন মানুষকে পূনর্বাসন ছাড়াও সবধরণের সেবা নিশ্চিত করে চলেছেন। এ ছাড়াও সারাদেশেই রাজা মিয়ার সহায়তার অবদান অস্বীকারের সুযোগ নেই। মানুষের শত্রæতা থাকে; কিন্তু এ ধরণের শত্রæতার কোন উত্তর নাই। এমন অসংখ্য গুণির কদরহীনের অপসংস্কৃতি নির্মূলে প্রজন্ম তৈরি হলেই বলা  যাবে, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়  হয়ে, কাজে বড়  হবে।

-লেখক: 
গণমাধ্যম ও মানবাধিকাকর্মী। 
০১৯১২১৮৫০৬২,
shahjamal.press@gmail.com




সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন

banner

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top