তারিক মেহেরের কাব্যগ্রন্থ ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়’ : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ

Seba Hot News : সেবা হট নিউজ
0

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: বর্তমান সময়ের একজন অনন্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কবি তারিক মেহের (জন্ম. ১০ই অক্টোবর ১৯৭৩)। তিনি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা ‘আর্টপেপার’র ব্যবস্থাপক ও প্রকাশক এবং জাতীয় কবিতা পরিষদ, জামালপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক।

তারিক মেহেরের কাব্যগ্রন্থ ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়’  একটি সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ
তারিক মেহের ও কাব্যগ্রন্থ ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়’ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ 


বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' (২০১৯)-এর প্রায় সব কবিতায় সরলভাবে আলাদা ঢঙে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন। কিন্তু তিনি যে কথা বলেন তা কিন্তু মোটেই সরল নয়। এ প্রসঙ্গে ‘শুভগ্রামের গল্প’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : 


শুভগ্রাম খুব একটা দূরে নয় অথচ

আমরা কেউই সেখানে পৌঁছুতে পারি না−

সেখানেও সূর্য আলো দেয়, চাঁদ হাসে এবং বাতাস প্রবহমান।

শুভগ্রামে রাজনীতি আছে কিন্তু তারা মিথ্যে বলে না;

শুনেছি সেখানেও নির্বাচন হয় রংবেরঙের প্রতীক নিয়ে সবাই মেতে উঠে উৎসবে।


 শুভগ্রামের অভিধান থেকে সংবিধানসম্মতভাবে 

কেটে দেয়া হয়েছে বিরহ শব্দটি ঋতু পরিবর্তনের নিয়মকে উপেক্ষা করে 

বছরজুড়ে চলমান থাকে বসন্তকাল 

এবং পুষ্পবেষ্টিত উদ্যানে 

চিরযুবক ও যুবতিরা দোল খেতে খেতে 

জপতে থাকে প্রণয়ের তজবিহ।


 শুভগ্রামের এইসব হাল-হকিকত দেখে 

বামুনরাজ্যের মানুষেরা বছরজুড়ে শুধু হা-হুতাশ করতে থাকে−

কেননা শুভগ্রাম খুব বেশি দূরে নয় সেখানেও সূর্য আলো দেয়, চাঁদ হাসে এবং বাতাস প্রবাহমান।

                                                                       [শুভগ্রামের গল্প, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ৯]

তিনি শুভগ্রাম নামের একটি কল্পিত স্থানের নাম কল্পনা করেছেন। সেখানে কেউ মিথ্যা বলেন না- কিন্তু সেই শুভ গ্রামে আমরা পৌঁছতে পারি না। কবির এই কাব্যভাষা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি চমৎকার সরলভাবে কল্পিত গ্রামটি চিত্রিত করেছেন কিন্তু তার বিষয়বস্তু সরল নয়।

তার এই কবিতা গভীর এক বোধের দিকে নিয়ে যায়। কবি রোমান্টিক ও নস্টালজিক ভঙ্গিতে তার কাব্যগ্রন্থভুক্ত অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। বিশেষত তার কবিতার বিরহতাপিত হৃদয়ের করুণ আর্তসুর শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে কাব্যগ্রন্থভুক্ত কয়েকটি কবিতাটির শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রণিধানযোগ্য : 


একাকী কিংবা সংঘ 

মিলন কিংবা বিচ্ছেদ

 থাকা কিংবা না থাকা-

অনিঃশেষ দ্বন্দ্বের ভেতর কেটে গেল জীবন।

[দ্বিধা, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ১১]



একদা সুদূর শৈশবে জলে-ভাসা বেদেনীরা 

চোখে ভেলকি লাগিয়ে চলে গিয়েছিল-

সে ভেলকি আমায় আজও ছাড়েনি।

[জীবনবাসনা, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ১৩]




বহুজন কেমন করে যেন বদলে যায় 

চিনেও না চেনার ভান করে চলে যায় পাশ কাটিয়ে

পুনর্বার কিছু ফিরে দেখে আবার চলে যায়-

আমি সে গমন পথের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি :

[বদলে যায় দিগন্তরেখা, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ১৮]



কবি শুধু এ সকল কবিতায় রোমান্টিক মনভঙ্গিতে সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রকাশমান তা নয়, এই বইয়ের কবিতাগুলোতে  রাজনৈতিক সচেতনতাও পরতে পরতে অনুভব করা যায়।  এ কথা বার বার উচ্চারিত হয় যে, রাজনৈতিক সচেতনতাই একজন কবির সকল মর্ম-বেদনার দিঙ্ নিদর্শক। কেননা রাজনৈতিক মুক্তির মধ্যেই সকল মুক্তি নিহিত রয়েছে। কবির কবিতার বিষয়গুলো সহজ-সরল হলেও দার্শনিকতা ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরিযায়ী পাখিদের দেখি’ শীর্ষক  কবিতাটির শব্দ চয়ন ও ভাষা লক্ষ্য করা যাক : 



আদতে রোহিঙ্গা কিংবা ফিলিস্তিনিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই 

ধর্মের করাত কেটেছে নৈকটের জাল ;

[পরিযায়ী পাখিদের দেখি, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ১৮]



এই কবিতাগ্রন্থে কয়েকটি কবিতায় সমসাময়িক কালের ভাষা ও চমৎকার চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। যেমন- 


সার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সময় 

আমার কাঁচা-পাকা চুলে আঁচড় কাটছে কালের আঙুল।

একটু একটু করে প্রতিদিন জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি ঋণে

আপাতত ছুটে বেড়াচ্ছে সাফা মারওয়া।

[বিভ্রান্তি, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ২১]



পাথর পাথর মুখের মানুষগুলোর গোপন কান্নার আওয়াজ 

ভেসে আসে হাওয়ার বাহনে। আর একরাশ অস্থিরতা নিয়ে 

গুলিতাড়িত পাখির মতন ইস্কুল মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। 

[পূর্বাভাস, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ২৯]


মৃত্যুচিন্তাও কবিকে তাড়িত করে। তিনি মৃত্যু নিয়েও ভেবেছেন। কবির মৃত্যুর নান্দনিকতা চিন্তা এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। তিনি মৃত্যুর পরবর্তীকালের জীবনের চালচিত্র কল্পনা করেছেন। যেমন-


একদিন এইসব মৃতের মিছিলে যোগ হবে আমার মুখ :

হেমন্তের কোন এক বিকেলে কিংবা 

চন্দ্রালোকিত কোনো এক মধ্যরাতে এশার সালাত শেষে 

তলানিসমেত পানপাত্র হাতে শূন্য দৃষ্টি 

প্রতিবিম্বিত হবে আয়নার শরীরে 

অথচ সেই বিম্বা আর কখনোই দেখা হবে না আমার।

 [যেদিন আমি থাকবো না, ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' পৃষ্ঠা ৩০]


কবি তারিক মেহের আমাদের চেনাজানা চারপাশের জগৎ থেকে তার কবিতার বিষয়াবলি নিয়েছেন। উল্লেখিত কবিতার বৈশিষ্ট্যাবলি যেমন- রোমান্টিকতা, নস্টালজিয়া, বিরহী ভাবনা, রাজনৈতিক মনস্কতা ইত্যাদি। কবি তারিক মেহেরের কবিতায় বিচিত্রতা, বর্ণীলতা মূলত এসবের মধ্যেই বিদ্যমান।

এক কথায় বলা যায়, আমাদের চারপাশের পরিচিত জগৎ থেকে কবিতার উপকরণ নিয়ে আলোচ্য কবি কবিতাকে সার্থক করতে সচেষ্ট হয়েছেন। কবি তারিক মেহের তার এ গ্রন্থের জন্য অনেকদিন আলোচিত হবেন। আমরা মনে করি, তারিক মেহের তার ‘শুভগ্রাম খুব দূরে নয়' কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংস্করণ বলে বিবেচিত হবে।


লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক




সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন

banner

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top