শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: মো. আব্দুল হাই আলহাদী মূলত কবি ও প্রাবন্ধিক (জন্ম. ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭২)। তিনি লিটল ম্যাগ ‘কর্ণঝুরা’র সহসম্পাদক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
মো. আব্দুল হাই আলহাদীর কাব্যগ্রন্থ ‘আগুইন্যা হবন' একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা |
জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে তিনি কাজ করছেন। এখানকার আঞ্চলিক ভাষা বেশ সমৃদ্ধ। এ অঞ্চলের ভাষার আলাদা ঢং, আলাদা উচ্চারণভঙ্গি ও টান রয়েছে। জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষায় গীতিনাট্য, আঞ্চলিক গান প্রভৃতি রয়েছে। এ অঞ্চলের ভাষা নিয়ে কেউ কেউ কবিতা লিখে থাকবেন। তবে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ খুব বেশি নেই। মো. আব্দুল হাই আলহাদী তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আগুইন্যা হবন’ (২০১৮)-এ জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
এ কাজটি এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি মান বা প্রমিত ভাষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে কবিতা লিখেছেন। আমরা মনে করি, জামালপুরের প্রচলিত কথ্য ভাষায় রচিত এ কাজটি বাংলাদেশের কবিতায় একটি উল্রেখযোগ্য সংযোজন। এ কাব্যে ভাষার বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। আঞ্চলিক শব্দ কতখানি নিখুঁত শব্দমালায় সাজালে কবিতা হয়, তা তিনি এ কাব্যগ্রন্থে চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘ফুরুইংগ্য‘ শীর্ষক কবিতাটির শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রণিধানযোগ্য :
ফুরুইংগ্যা
ছোডত তনে ঘাস পাতা ফুল দিয়া খেলাই
বয়স আঠারো ঐলোতো মইল্যাম!
খেলা নাই বেলা নাই ঘুম নাই খাওন নাই
আরো কী জানি কী নাই
চোক্কের সামানে খালি ওরেই দেহি ওরেই দেহি
চেতনে হবনে বেকসুমই দেহি
টকটকা লাল আগুনের ফুরুইংগ্যা।
জীবনডা পুইড়্যা কাই!
আংরার মতো চুলায় জ্বলতাছি
জ্বলার আর শেষ নাই!
ছেলের বাবা ওরে দেইখ্যা কয়
ম্যায়া খুব পছন্দ অইছে
এক্কেবারে আগুনের ফুরুইংগ্যা।
আমিওতো মনে মনে কই,
আগুনের ফুরুইংগ্যা বইল্যাই তো
কবে থাইক্যা পুড়তাছি!
[আগুইন্যা হবন, পৃষ্ঠা ১৫]
আঞ্চলিক ভাষায় এ কবিতায় কী সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রকাশমান তা এই বইয়ের পরতে পরতে অনুভব করা যায়। এ কথা বার বার উচ্চারিত হয় যে, বাংলা ভাষার আঞ্চলিক ভাষা প্রবাহ এ ভাষার প্রাণ সঞ্চার করছে। মো. আব্দুল হাই আলহাদীর ‘আগুইন্যা হবন’ গ্রন্থের কবিতাগুলো আধুনিক সাহিত্য বিচারে মূল্য থাকুক বা নাই থাকুক- তবে সপ্রাণ-সহৃদয়হৃদয়ের সংবেদী উচ্চারণ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ৫০টি কবিতায় বিবৃত হয়েছে সহজ সরল কথামালা, প্রাত্যহিক জীবনের প্রসঙ্গ, মৃক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি, প্রেম, পারিবারিক প্রসঙ্গ, গ্রাম্যজীবন ইত্যাদি। বিষয়গুলো সহজ-সরল হলেও দার্শনিকতা ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘ছালুন’ কবিতাটির শব্দ চয়ন ও ভাষা লক্ষ্য করা যাক :
ছালুন
কী আন্দে গো কলি মাও. নায়ের ছালুন কত খাও?
নায়ে নাকি রাগ ওঠে না, ডাঙা খাইলে শৈল বাড়ে না !
বু যে আমার কী সব কয়, বেবাকইতো খাইতে অয়
আনাইছপাতি মূইল্যা খাই, আরো তো খাই বিল্যাতি নাই।
হাগ-পাতা সব খাওন ভালা, কইছে আমার ছোট খালা।
ঠিকই কইছ, সবই খাই, আতের কাছে যা যা পাই
কাঁচা মোইচ হৈল্যা হজে, পিঁয়্যাজ ডইল্যা খুব সহজে
খাইছি কয়ডা করকরা ভাত , কীয়ের ইয়্যাল কীয়ের গো স্বাদ।
পুনাইর বাপে আনছে থুর, মুখে নাইংক্যা কোন জোর
হুটকি আনতে ভুইল্যা গ্যাছে, আইলাম গো তাই তোমার কাছে।
গুণ্ডা দুয়েক হুটকি পাইলে, আইন্দ্যা খামু বিনা ঝোলে।
স্বাদের ছালুন আগুন মাসে, খাইতে পাইলে কে না হাসে।
[আগুইন্যা হবন, পৃষ্ঠা ২৮]
এই কবিতায় সমসাময়িক কালের জামালপুরের গ্রামাঞ্চলের মুখের ভাষার এক সুন্দর সাবলীল বর্ণনা রয়েছে যা অপূর্ব। ভবিষ্যতে এ বইটি জামালপুর অঞ্চলের গ্রামীন ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করবে। এ জন্য কবি মো. আব্দুল হাই আলহাদী তার এ গ্রন্থের জন্য অনেকদিন আলোচিত হবেন। এই বইখানা পড়ে অনেকেই হয়ত আঞ্চলিক ভাষায় লিখতে উৎসাহিত হবেন, যেটা হতে পারে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা লিপিবদ্ধ করার এক প্রচেষ্টা। আমরা মনে করি, মো. আব্দুল হাই আলহাদীর ‘আগুইন্যা হবন' কাব্যগ্রন্থটি আঞ্চলিক ভাষায় কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংস্করণ বলে বিবেচিত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।