সেবা ডেস্ক: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রমে চাপে রয়েছে; ইইউ ও জার্মানি সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংকট: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণ |
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রতিশ্রুত সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ততই চাপের মুখে পড়ছে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। তাদের সাম্প্রতিক 'ওয়াচ লিস্ট ২০২৫' প্রতিবেদনে আইসিজি উল্লেখ করেছে যে, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো সংস্কার নিয়ে দর-কষাকষি করছে এবং নির্বাচনী সুবিধা লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এতে করে এ বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে।
আইসিজি'র মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, "বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, "জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে তারা।" এছাড়া, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তাও সরকারের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
তবে, আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এ লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েক শ প্রস্তাবসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমর্থন ও অন্তর্বর্তী সরকার যাতে দেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, সেটা নিশ্চিত করতে আলাপ-আলোচনা, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
এ প্রেক্ষাপটে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্যদেশগুলো বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তা করতে পারে। আইসিজি'র মতে, ইইউ'র উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। এছাড়া, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে বিভিন্ন মতবিরোধ ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও, সঠিক পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে দেশটি একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
পর্যবেক্ষণ তালিকায় উল্লেখ করা বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাসের কম সময় পর অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রত্যাশা, ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক শাসনের পর এ নির্বাচন শুধু গণতন্ত্রই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে না; বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
হাসিনার আওয়ামী লীগ তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে রাষ্ট্রযন্ত্রের বড় অংশে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। দলটি এখন রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক, নির্বাচনী, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে হাসিনার পতনের পরপর অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, তা ম্লান হতে শুরু হয়েছে এবং অধ্যাপক ইউনূস এখন (অভ্যুত্থানের) সুনির্দিষ্ট ফলাফল দেখানোর জন্য চাপের মুখে পড়ছেন। সরকার শুধু যে অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে মতপার্থক্য দূর করার সংগ্রাম করছে তা নয়, দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা নিয়েও লোকজনের সমালোচনার শিকার হচ্ছে তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এসব চ্যালেঞ্জ এ বছর আরও বাড়তে পারে। কেননা বিরোধী দলগুলো, ছাত্রনেতারা, ইসলামি দলগুলো ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য শক্তি নির্বাচনী সুবিধা আদায়ে তৎপর। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। হাসিনা সরকারকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শক্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়া দেশটির সঙ্গে এমন সম্পর্কও বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক বাধা। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর দেখভালের দায়দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক উত্তরণে সমর্থন দেওয়ার ও অত্যন্ত গুরুত্বের ভূরাজনৈতিক একটি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের (বাংলাদেশ) সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইইউর সামনে বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ইইউ ও এর সদস্যদেশগুলোর যা করা উচিত
—বাংলাদেশে উচ্চপর্যায়ের সফর আয়োজন করতে হবে ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজে সমর্থনের ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে; যাতে দেশের অভ্যন্তরে অধ্যাপক ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং তার কর্মসূচি ক্ষুণ্ন করতে চাওয়া শক্তিগুলো দুর্বল হয়। নতুন অংশীদারি প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক চুক্তি করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে ইইউকে।
—অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে কারিগরি এবং আর্থিকভাবে সমর্থন দেওয়া দরকার। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে ইইউ। এ জোটের উচিত হবে, নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণে একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো।
—বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় অবদান রাখা দরকার। এ লক্ষ্যে দেশটির জন্য বাড়তি অর্থনৈতিক সমর্থন আদায়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিজের প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারে ইউরোপ। অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার—আরও আকর্ষণীয় বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা, তৈরি পোশাক উৎপাদন খাতের বাইরে এনে দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সমর্থন, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা এবং ২০২৯ সালের পরও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করতে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
—ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কাজ করা প্রয়োজন। উভয়ের মধ্যে অনাস্থা কাটিয়ে সম্পর্ককে ভালো অবস্থানে নিতে ইইউর উচিত হবে দুই পক্ষের ওপরই প্রভাব খাটানো।
—রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাঁদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা—উভয়কে সহায়তা করতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অর্থায়ন বজায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের ওপর জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজন করতে ঢাকা যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে সহায়তা প্রদান এবং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে।
সংস্কারের জন্য জানালা
গণভবন অভিমুখে লাখো বিক্ষোভকারীর ধেয়ে আসার মুখে আগস্টের শুরুতে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরও মাসখানেক আগে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। পরে তা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। নিষ্ঠুরভাবে বিক্ষোভ দমনে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টা তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর পতন বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক এক মূহূর্ত।
দেশ ও দেশের বাইরে অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি যে শ্রদ্ধা রয়েছে, সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা আদায়, উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক সংস্কারকাজে সমর্থন জোগাড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় ছিল জরুরি। হাসিনাকে উৎখাতের সঙ্গে যে উচ্ছ্বাস মিশে ছিল, তা ইউনূসের প্রশাসনের জন্য ব্যাপক সমর্থনে রূপ নেয়। মধুচন্দ্রিমা শেষ। শুধু প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করাই নয়; বরং দৈনন্দিন শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্যও এ সরকারের ওপর জনগণের চাপ বেড়েছে।
এসব চাপের একটি হচ্ছে, নতুন জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ওপর চাপ ক্রমে বাড়ছে। গত ১৬ ডিসেম্বর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অর্থ, তাঁর প্রশাসন দুই বছরের কম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবে। তাঁর এ ঘোষণা সমালোচকদের সবাইকে না হলেও তাঁদের বড় অংশের মুখ বন্ধ করেছে।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার বাইরেও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার অনেক কিছু ও নির্বাচন-পরবর্তী সময় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কয়েকটি কমিশন ইতিমধ্যে তাদের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারকাজ চালানোর সুপারিশ করেছে তারা। মুহাম্মদ ইউনূসও একটি কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন। এটি সব কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর তা নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে। এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, কোনগুলো বাদ দেওয়া হবে বা ভবিষ্যতের সরকারের জন্য রেখে দেওয়া হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ের ওপর নির্ভর করছে এ প্রক্রিয়ার সাফল্য।
রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে হাসিনার আওয়ামী লীগের প্রায় হারিয়ে যাওয়া, নেতাদের পলায়ন ও দেশের ভেতর দলটির কর্মকাণ্ড অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিএনপি। দলটি ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের অপেক্ষায় আছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। তবে এমন সম্ভাবনায় বাংলাদেশের অনেকেই ভীত।
অতীতে, বিশেষ করে একবিংশ শতকের শুরুতে হাসিনার আওয়ামী লীগের মতোই অনেকটা একই রকমের স্বৈরশাসন প্রদর্শন করেছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার ও এর সমর্থকদের জন্য এটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। ফলে এ সরকারের সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য, দেশকে আবারও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করা। অবশ্য ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য জনগণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা মুহাম্মদ ইউনূসকে কিছুটা সুবিধা এনে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে ‘ভক্ষকের’ মতো ভূমিকা এড়াতে চাইবে বিএনপি।
রাজনৈতিক জটিলতা ছাড়াও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি, আর্থিক খাতে তাঁর সঙ্গী-সাথিদের লুটপাট নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। সরকারের এক তদন্ত অনুযায়ী, অর্থনৈতিক খাতের ওই অরাজকতা অন্তত ১০টি ব্যাংককে ‘কার্যত দেউলিয়া’ করে ফেলেছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের ‘নতুন বাংলাদেশের’ সামনে থাকা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে অপতথ্য ও প্রতিবেশীর উদ্বেগ মোকাবিলার বিষয়ও। দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে এ সরকারকে। অভিযোগের অধিকাংশ আসছে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ভারতের কাছ থেকে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ ও হাসিনার একনিষ্ঠ সমর্থক।
নিঃসন্দেহে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরের কয়েক দিনে। ওই দিনগুলোতে পুলিশ বাহিনী অনেকটাই ছিল নিষ্ক্রিয়। তবে সংখ্যালঘুদের ওপর ওই হামলা ছিল যতটা না সাম্প্রদায়িক, তার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে। তা ছাড়া যে মাত্রায় হামলা হয়েছে, সেটি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধীরা। একইভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে ইসলামি শক্তিগুলোর হাত ও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকার অভিযোগও বিভ্রান্তিকর। ইসলামভীতির নাটক সাজিয়ে ঢাকার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থনকে দুর্বল করাই দৃশ্যত এসব অভিযোগের কারণ।
এ হামলা নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর দায়দায়িত্বের অনেকটা ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদেরও। তাঁদের সঙ্গে প্রভাবশালী বিদেশি হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিতে ভূমিকা রেখেছে। অভিযোগগুলোর উৎপত্তি ও এর ধারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জটিল করে তুলেছে।
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন বাংলাদেশিদের মধ্যে তৈরি করেছে গভীর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। ভারত ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে খাটো ও আওয়ামী লীগকে ফেরানোর চেষ্টা করছে—এমন ধারণায় গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে তুলেছে। ভারত হাসিনাকে শুধু আশ্রয় দেয়নি, বাংলাদেশিদের সে দেশের ভিসা পাওয়াও জটিল করে দিয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে ঢাকার সমালোচনা করছে। পাওনা আদায় নিয়ে জটিলতার জেরে বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ আটকে দেওয়া ও সীমান্তে ভারতের বেড়া দেওয়া নিয়ে বিতর্ক দুই দেশের সম্পর্কের উত্তেজনায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
ইইউর কী করা উচিত
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ নিজেদের জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তি ও জবাবদিহিমূলক করে তোলার বিরল সুযোগ পেয়েছে। এই সংস্কারকাজে সফল হতে আন্তর্জাতিক সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং ইইউর উচিত এই প্রক্রিয়ায় যথাসাধ্য সহায়তা করা।
ভালো একটা শুরু হবে ইউনূস প্রশাসনের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। এ ক্ষেত্রে ইইউকে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। গত বছরের জুলাইয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করেছিল ইইউ। নভেম্বরে আবার তা শুরু হয়েছে।
এ ধরনের সমর্থন আগামী মাসগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ, সরকার যেসব খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচিকে লাইনচ্যুত করতে বিরোধীদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এবং দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের চাপও আছে।
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, তা প্রতিরোধে ইইউ বেশ কয়েকটি ছোট ছোট প্রকল্পে সহায়তা দিতে শুরু করেছে, যার মধ্যে সুশীল সমাজকে সমর্থনও অন্তর্ভুক্ত।
নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে সহায়তার জন্য ব্রাসেলসের প্রস্তুত থাকা উচিত। সেই সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইন সংস্কারের মাধ্যমে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারের সুরক্ষায় ইইউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইইউর উচিত, যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দিতে চাইছে তাদের দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে ইউনূস সরকারকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া।
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীদের সুযোগ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতেও কাজ করতে হবে। পরিস্থিতি আরও উন্নত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
এ ক্ষেত্রে ইউনূস সরকারের প্রশাসনকে একজন আগ্রহী অংশীদার ধরে নেওয়া যেতে পারে। ইউনূস সরকার অন্তর্ভুক্তিকে তাদের সংস্কার কর্মসূচির একটি স্তম্ভ বলেছে এবং বেশ কয়েকজন নারী ও সংখ্যালঘু নেতাকে তাদের সরকারব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তবে ইইউর উচিত, এ ধরনের ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরামর্শ দেওয়ার সময় সতর্ক থাকা। বিশেষ করে এলজিবিটিকিউআই অধিকার নিয়ে কথা বলার সময়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজে সহায়তার মাধ্যমে ইইউ বাংলাদেশে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। সেখানে ইইউ এর আগে সাবেক সরকারকে অতিরিক্ত সমর্থন করে গেছে এবং অধিকাংশ সময় নিজেদের আর্থিক স্বার্থের দিকটিই শুধু বিবেচনা করেছে। অবশ্য সব ক্ষেত্রে তারা অন্যায্য ছিল, এমনটা বলা যাবে না।
ইউরোপীয় কূটনীতিকদের মধ্যে কারও কারও প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। এখন ইইউর উচিত, দেশটির সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ বাড়ানো। যাদের মধ্যে ছাত্রনেতা এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীও রয়েছে। এরা এখন বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপটের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
হাসিনার আমলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি ব্রাসেলস রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারকাজে সহায়তা করতে এবং তাড়াহুড়া করে নির্বাচন আয়োজন না করতে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও গভীর স্থান করে নিতে পারে।
তিনটি ত্রুটিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা ফেরাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এ ক্ষেত্রে ইইউর বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ব্রাসেলস একটি নজরদারি দল পাঠাতে পারে, যারা বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের ওপর নজর রাখবে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ইইউ দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নেও সহায়তা করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে।
যদিও দেশটির অর্থনীতি বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
ইইউ নানাভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করতে পারে। প্রথমত, নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আর্থিক খাতের আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে ইইউ বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উন্নত করতে পারে।
তৃতীয়ত, ইউরোপের দেশগুলোতে নিরাপদে এবং বৈধ পথে আরও অভিবাসী পাঠানোর পথ প্রশস্ত করার মাধ্যমে ইইউ বাংলাদেশের বৈদেশিক আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। যেমন ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারে।
এবং সর্বশেষ, হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, যাঁরা অবৈধভাবে ইইউর বিভিন্ন দেশে সম্পদ গড়েছেন, সেসব দেশ নিজ নিজ দেশ থেকে সম্পদ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করতে পারে।
ইইউ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নেও কাজ করতে পারে। ইউরোপীয় কূটনীতিকেরা নয়াদিল্লির কাছে জোর দিয়ে বলতে পারে, আওয়ামী লীগ এখন আর তাদের জন্য কার্যকর কৌশল নয়।
পরিশেষে, ইইউ এবং এর সদস্য দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনে তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যেতে পারে। গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক তহবিল অনেক কমে গেছে।
যদিও ইউরোপের কয়েকটি দেশ তাদের সহায়তা হ্রাস করেছে। এরপরও রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি দাতাদের একজন ইইউ।
উপরের নিউজটিতে আরও কিছু তথ্য যুক্ত করে সম্প্রসারণ ও সম্পাদন করে দাও, এসইও রিলেটেড লেখাগুলো বল্ড করে দিবে, তারপর এসইও রিলেটেড একটি ৬০ অক্ষরের টাইটেল ও ১৫০ অক্ষরের ছোট বিবরণ এবং বিষয়টি যদি Google Trending এ থাকে তাহলে বিশ্লেষন করে ৪টি ছোট কিওয়ার্ড জেনারেট করে দাও, কিওয়ার্ডগুলো, দ্বারা আলাদা করবে, থাম্বেনেইল এর জন্য ছোট করে একটা টেক্সট লিখে দিবে,
তারপর নিউজটি আমি আমার নিউজ পোর্টালে পাবলিশ করবো, পাবলিশ শেষে নিউজ লিংক ফেসবুক এ পোস্ট করবো, এর জন্য একটি ক্যাপশন সহ আলাদাভাবে পোস্ট জেনারেট করে দাও।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।