মো: ফয়জুর রহমান: ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর : শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে দিবসটি।
শনিবার (৫ অক্টোবর) সকালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
উক্ত সভাকক্ষে আলোচনা সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, 'বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
স্বল্প আয়ে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য দুঃসাধ্য, শিক্ষকতায় তারা কিভাবে মনোযোগ দেবেন।'
পৃথিবী জুড়ে দেশে দেশে দিবসটি পালনে শিক্ষকদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করলেও বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। এটার কারণ হলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা সন্তোষজনক হলেও এদেশে তেমনটা নেই। বিশেষ করে এদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান একেবারে শোচনীয়। বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর বাকি ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। নির্ধিদ্বায় বলা যায়, দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীক। এটি শিক্ষাব্যবস্থার সিংহভাগ ক্ষেত্র হলেও এখানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারিরা চরম বৈষম্যের শিকার।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন সহকারী শিক্ষক চাকরিতে যোগদান করে বেসিক বেতন পান ১২৫০০ টাকা, বাসা ভাড়া পান ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। যেখান থেকে আবার অবসর-কল্যাণ ফান্ডের জন্য ১২৫০ টাকা কেটে রাখা হয়। মাস শেষে সর্বসাকুল্যে তার একাউন্টে জমা হয় ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। দীর্ঘদিন নতুন পে স্কেল না হওয়ায় সবাইকে স্পেশাল বেনিফিট হিসাবে বেসিকের ৫ শতাংশ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় ১২ হাজার ৭৫০ টাকায় একজন সহকারী শিক্ষক কিভাবে সংসার চালান তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এইতো গেলো প্রতি মাসের হিসাব। দুই ঈদ ও বৈশাখে উৎসব ভাতা নামে যে বোনাস শিক্ষকদের দেয়া হয় তা একেবারে যৎসামান্য। এটা শিক্ষকদের জন্য যেমন অপমানের তেমনি জাতি হিসেবেও সবার জন্য লজ্জার। উৎসব ভাতা হিসেবে শিক্ষকদের বেসিকের ২৫ শতাংশ বোনাস দেয়া হয়। অর্থাৎ একজন সহকারী শিক্ষক বোনাস পান ৩১২৫ টাকা। নামমাত্র এসব বোনাস দিয়ে একজন শিক্ষক কতটুকু উপকৃত হন তা ভাববার বিষয়। অথচ সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বেসিকের পাশাপাশি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাসা ভাড়া এবং শতভাগ ঈদ বোনাস দেয়া হয়।
একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর চলমান ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষকসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিগত দিনে দালাল কিছু আমলা, মন্ত্রী, এমপি', পা চাঁটা, তেলবাজ নেতা যাদের কারণে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারীগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন। বিগত ফ্যাসিবাদি সরকারের আমলে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের আন্দোলন হয়েছে বহুবার। কিন্তু জাতি গঠনের কারিগর এসব শিক্ষকদের আন্দোলনের ন্যূনতম প্রতিদান দেয়নি শেখ হাসিনা সরকার। উল্টো পুলিশ দিয়ে শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলন নস্যাৎ করে দেয়ার নজীর রয়েছে। গতবছর জুলাই-আগস্টে টানা ২১ দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন করে মিথ্যা আশ্বাসে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের।
'শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, আর শিক্ষকরা সেই মেরুদন্ডের রূপকার।' তাদের শেখানো পাঠ-পঠনে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মুখে ‘শিক্ষকতা মহান পেশা’ স্বীকার করে শিক্ষকদেরও যে সংসার আছে, মৌলিক চাহিদা আছে, সেদিকে তাকানোর সময় হয়নি কোন সরকার বাহাদুরের। জাতীয়করণের ব্যাপারে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রায়ই বলতেন এটা ব্যাপক গবেষণার ব্যাপার। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য দূরীকরণে পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি গবেষণার নামে কালক্ষেপণ করতেন। দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থীগণকে পাঠদানকারী শিক্ষক কর্মচারীরা বর্তমানে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের দৈন্যদশায় রেখে শিক্ষার বাস্তব উন্নয়ন কোনোভাবে সম্ভব নয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার দাবি বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের।
শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখে। অথচ অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে মেধাবীরা বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে আসতে একেবারে আগ্রহী হন না। বর্তমানে যারা এখানে যোগদান করছেন বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনিচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষকের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি হচ্ছেন। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিক্ষার্জন করবে মানসিক অশান্তিতে ভোগা এসব শিক্ষকের কাছ থেকে। অতিসত্বর সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা সময়ের উপযুক্ত দাবি। সুষ্ঠু সমাজ, সুন্দর দেশ, তথা সুন্দর পৃথিবীর জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই আগামী দিনে সুন্দর পৃথিবী প্রত্যক্ষ করতে চাইলে বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।