জি এম ক্যাপ্টেন, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: টানাটানির সংসারে ৪০শতক জমিই ছিল শেষ ভরসা। সেই জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করে মুখের আহার জোটানোর পাশাপাশি টাকা জমিয়ে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কৃষাণি জোহরা বেগম।
একজন সফল চাষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। কখনো কখনো লোকসানও পোহাতে হয়েছে তাকে। এতে দমে না গিয়ে হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে আবার নতুন উদ্যোমে চাষাবাদে মনযোগ দিয়েছেন।
তবে এবারে প্রথমবার পরিবেশবান্ধব পলিথিন দিয়ে মালচিং পদ্ধতিতে করলা চাষ করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে।
কুড়িগ্রাম জেলায় সবজির আঁধার নামে খ্যাত রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের মীরেরবাড়ী এলাকার বাসিন্দা জোহরা বেগম। সংসারে তিন মেয়ে আর দুই ছেলে আসার পর ভীষণ দুশ্চিন্তায় রাত কাটছিল তার। স্বামী মনসুর আলী টুকটাক কাঠ কিনে ছ’মিলে বিক্রি করেন। লাভ তেমন হয় না। নিজেদের দুই দাগে ৪০ শতক জমি আগেই বর্গা দেয়া ছিল। অভাবের কারণে বিভিন্ন সমিতিতে যুক্ত হন জোহরা বেগম। সেখানে প্রশিক্ষণ ও সাহস পেয়ে নিজেই জমিতে চাষাবাদের কাজে লেগে পরেন। তার কাজে ছেলে-মেয়েরাও হাত লাগায়। জমিতে তিনি বিভিন্ন সিজনে আলু, মরিচ, পটল, লাউ, করলা, চিচিঙ্গাসহ নানাবিধ ফসল চাষ করেন। এভাবে কৃষিভিত্তিক কাজের সাথে অভ্যস্থ হয়ে পরেন তিনি। ফলে আগ্রহ বাড়ে নতুন চাষাবাদে। তাই এবার তিনি পরিবেশবান্ধব পলিথিন দিয়ে এই এলাকায় এই প্রথম মালচিং পদ্ধতিতে করলা চাষ করেছেন। এই পদ্ধতি সম্পর্কে এলাকার মানুষ কিছুই জানেন না। ফলে তারাও অপেক্ষা করছিল এভাবে চাষ করলে সুবিধা কি! লাভই বা কেমন হয়।
জোহরা বেগম জানান, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। যখন চাষাবাদের কাজে যুক্ত হলাম, তখন থেকে সংসারের অভাব কিছুটা দূর হওয়া শুরু হলো। একটু থিতু হওয়ার পর অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে এই সবজি বিক্রি করেই এক এক করে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এই জমিই আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। সম্মানের জায়গা করে দিয়েছে। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে দিন পার করছি।
তবে জোহরা বেগমের সংসারে এবার নতুন সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দিয়েছে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ। পরিবেশবান্ধব পলিথিন দিয়ে এবার প্রথম করলা চাষ করেছেন তিনি। প্রথমে আশংকা ছিল ফলাফল কেমন হয়। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিল ততই আশার মুখ দেখছিলেন তিনি। স্থানীয় আরডিআরএস বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় সার, বীজ ও পরিবেশবান্ধ পলিথিন সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। এতে আরডিআরএস ১০ হাজার টাকার তাকে সহায়তা করেছে। অপরদিকে জোহরা বেগম একশ টাকা দরে ৪০টি বাঁশ কিনে স্বামী-ছেলেসহ জাংলা তৈরী করেছেন। জমির চারপাশে দুই হাজার টাকা ব্যয় করে নেট দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন। যাতে গবাদিপশু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া নিজেরাই নিড়ানিসহ জমির পরিচর্চা করেছেন।
জোহরা বেগম আরো জানান, নিজেরা শ্রমিকের কাজ করেছি। ফলে বেশি খরচ হয়নি। মাত্র ৭ হাজার টাকায় জমি তৈরী করতে পেরেছি। সবচেয়ে ভালো দিক হলো অন্যান্য করলার চেয়ে মালচিং পদ্ধতিতে করলা এক মাস আগেই উত্তোলন করা যায়। ফলে ওই একমাস বেশি দামে করলা বিক্রি করা যায়। শুরুতে তিনি ২হাজার ৪শ’ টাকা দরে করলা বিক্রি করেছেন। মাঝারি আকারের এই করলা তেমন তেতো নয়। বাজারে চাহিদাও প্রচুর। ফলে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন মন করে করলা বিক্রি করতে পারছেন। গত ৭ জানুয়ারি করলা চাষ করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার করলা বিক্রি করতে পেরেছেন। আরো ২/৩ মাস এই করলা বিক্রি করতে পারবেন। সামনে ইচ্ছে ছেলের বিয়ে দিয়ে নতুন বউ আনবেন।
আরডিআরএস রংপুর বিভাগের টিম লিডার বিদ্যুৎ কুমার সাহা জানান, সাধারণভাবে করলাচাষে খরচ বেশি হয়। ঝড়বৃষ্টি ও প্রচন্ড খড়া হলে করলার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু মালচিং পদ্ধতিতে উঁচু পলিথিনের ভিতরে করলা গাছ আবরিত থাকায় বেশি নিরাপদে থাকে। আমরা স্মার্ট কৃষিতে সাধারণ কৃষকদের সম্পৃক্ত করতে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় সমন্বিত কৃষি ইউনিটের আওতায় এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করছি।
রাজারহাট উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. সাইফুন্নাহার সাথী জানান, বর্তমানে উচ্চমূল্য ফসলের মধ্যে করলা একটি অন্যতম ফসল। মানুষের আহারের তালিকায় করলা জায়গা করে নিয়েছে। কৃষকদের মালচিং পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হলে ব্যাপকভাবে এর সম্প্রসারণ ঘটাতে পারি। আগামভাবে করলা চাষে কৃষকরা বেশ লাভবান হবেন।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।