শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: ব্যস্ত রংপুর শহরের ধাপ জেল রোডে চোখে পড়বে ‘হাইপোটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন ডা. মো. জাকির হোসেন।
কিৎসা আন্দোলনের নাম। ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয়- He is an institution himself. অর্থাৎ তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রবচনটি যার বেলায় প্রযোজ্য তিনি ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি চিকিৎসক জীবনে অনেক রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ রোগীর নানান সমস্যা অবলোকন করে এসেছেন।
যা বাংলাদেশে গড়ে এক-চতুর্থাংশ মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ রোগটি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উচ্চ রক্তচাপ বা হাই বøাড প্রেসারকে “নীরব ঘাতক ব্যাধি” হিসেবে অভিহিত। এই রোগের সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না এবং তেমন কোনো কষ্ট অনুভূত না হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ রোগটির চিকিৎসা গ্রহণে উদ্যোগী হয় না কিংবা চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় না থাকলে আমাদের অজান্তেই হৃৎপিÐ, মস্তিষ্ক, কিডনি, চোখ ও রক্তনালীগুলোর নানা রকম ক্ষতি হতে থাকে। ফলে আমরা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি রোগের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকি। এমনকি এই রোগের জটিলতায় বরণ করে নিতে হতে পারে পঙ্গুত্ব অথবা অকাল মৃত্যু।
তবে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ রোগটিকে যেমন প্রতিরোধ করা সম্ভব তেমনি যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে বøাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলোও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এদেশে এই রোগের চিকিৎসা নেওয়ার মতো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড়ই অভাব। ডা. মো. জাকির হোসেন এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর ‘হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’, রংপুর প্রাতষ্ঠা করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব সহজ সরল উচ্চ রক্তচাপ রোগের জটিল চিকিৎসার খ্যাতিমান ডাক্তার ‘হাইপার টেনসন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশের খ্যাতকীর্তি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, রংপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বর্তমানে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. জাকির হোসেনের জন্ম ১৯৬১ সালের ১০ই ডিসেম্বর বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ ও মাতা মোছা. ওয়ালেদা খাতুন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা প্রাথমিক (১৯৭২), মাধ্যমিক (১৯৭৭) ও উচ্চমাধ্যমিক (১৯৭৯) বগুড়ার ধুনটের গোসাইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোসাইবাড়ী এ. এ. উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজে। পঞ্চম (১৯৭২) ও অষ্টম (১৯৭৫) শ্রেণিতে সরকারি মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি অর্জন।
১৯৮৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) থেকে মেডিসিনে এফসিপিএস এবং ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত তদানীন্তন আইপিজিএম অ্যান্ড আর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইন্টারনাল মেডিসিনের ওপর এমডি ডিগ্রি অর্জন।
২০০৫ সালে আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস থেকে এফএসিপি এবং ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের দি রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অব এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি অর্জন। অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন কাটিয়েছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্মস্থলগুলো হলো কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর তৎকালীন থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ঢাকার মহাখালীস্থ সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ প্রভৃতি। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন শেষে ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করেন।
বর্তমানে তিনি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিসিএস ক্যাডারের অফিসারদের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক এবং মেডিকেল সম্পর্কিত উচ্চতর ডিগ্রির অন্যতম প্রধান পরীক্ষক। গ্রামবাংলার সাদামাটা সাধারণ মানুষকে তিনি ভালোবাসেন, তাদেরকে সুচিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন এবং এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান-বিষয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টির বেশি প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন করেছেন তিনি। অসংখ্য মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ৪০টির বেশি প্রবন্ধ। দেশের পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে স্বাস্থ্য সমস্যা ও সচেতনতা নিয়ে সাক্ষাৎকার ও আলোচনা অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করছেন এবং ইতোমধ্যে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে সাধারণ পাঠক ও রোগীদের বোধগম্য বাংলা ভাষায় তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত বই ‘রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ’ (২০২৪)। গ্রন্থটি সর্ব সাধারণমহলে ব্যাপক আদৃত হয়েছে। তিনি উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।
অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন এদেশের মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রংপুর শহরে ‘হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’, ‘অটিজম সেন্টার’ স্থাপন করেন এবং ‘সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে’ দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে পেশায় চিকিৎসক হিসেবে রোগীদের নিয়মিত সেবা প্রদানের পাশাপাশি নিজ গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, ডা. ওয়াছিম ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশন, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক ভাতা প্রদান, গুচ্ছগ্রামে জমিদাতা, গণগ্রন্থাগার, মসজিদ, কবরস্থান প্রতিষ্ঠাসহ নানা সামাজিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সেসবের কয়েকটি হলো : বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনের মেডিসিন ফেলো, রংপুর ডায়াবেটিক সমিতির জীবন সদস্য, বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতির জীবন সদস্য ও বর্তমানে সহসভাপতি, বগুড়া ভাই পাগলা মাজার জামে মসজিদের সহসভাপতি, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের জীবন সদস্য, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের জীবন সদস্য প্রভৃতি অন্যতম।
অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত ৭টি বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে যুগের আলো গুণিজন সংবর্ধনা (২০১৩), জাকারিয়া মেমোরিয়াল মেডেল (২০১১), চিকিৎসা পদক (২০২১), প্রফেসর এসজিএম চৌধুরী মেমোরিয়াল অরেশন গোল্ড মেডেল (২০২৩) প্রভৃতি অন্যতম। ২০২২ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমি সাম্মানিক ফেলোশিপ’ অর্জন করেন।
প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন একপুত্র ও এক কন্যার জনক। সন্তানদ্বয় তাঁদের পিতারই পদাঙ্ককে অনুসরণ করছেন। তাঁর কন্যা ডা. মোছা. পারিসা বিনতে জাকির, এফসিপিএস (পার্ট-১ উত্তীর্ণ) ও ছেলে মো. জুনায়েদ বিন জাকির, এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত। ডা. জাকির হোসেনের স্ত্রী নাসরিন নাহার রউফ একজন সার্থক গৃহিণী। এই দেশপ্রেমিক গুণী চিকিৎসক মানুষটির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রইল।
লেথক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।