সেবা ডেস্ক : এক বছরে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদন করে রেকর্ড করলো বাংলাদেশ। দেশে চা চাষের ১৭০ বছরের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ উৎপাদন।
সোমবার রাত পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে, গত ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মোট প্রায় ১০ কোটি ১৯ লাখ ৯৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। প্রতি মাসে চা উৎপাদনের তথ্য দেশের মোট ১৬৮টি বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সোমবার রাত পর্যন্ত ১৩০টি বাগানের তথ্য মিলেছে। বাকি ৩৮ বাগানের তথ্য এলে এই পরিমাণ আরো বাড়বে। এর আগে ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল, এতদিন সেটাই ছিল রেকর্ড। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসে এটা এক বিশাল অর্জন। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। “চায়ের মান বাড়াতে প্রশিক্ষণসহ সবরকম সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আর রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাজার তৈরির কাজ চলছে।” চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান তানভীরুর রহমান বলেন, “শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মাথায় রেখে রপ্তানি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মান ঠিক রাখতে হবে। নয়ত যে দামে চা বর্তমানে নিলামে বিক্রি হচ্ছে তাতে অনেক বাগান হুমকির মুখে পড়বে।” দেশে চা উৎপাদনে ১০ কোটি কেজির মাইলফলকে পৌঁছানোর হাতছাতি প্রথমবার দেখা যায় ২০২১ সালে। সেবার ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজির রেকর্ড উৎপাদনে বছর শেষ হয়। এরপর ২০২২ সালে ১০ কোটি কেজির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বছর শেষ হয় ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি উৎপাদনের হিসাব পাওয়া যায়। সবশেষ ২০২৩ সালে লক্ষ্য ধরা হয় ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি। বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মো. নূরুল্লাহ নূরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ (সোমবার) সন্ধ্য পর্যন্ত ১৩০টি বাগানের হিসেব পেয়েছি। তাতে ২০২৩ সালের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ১৯ লাখ ৯৯ হাজার কেজি। বাকি ৩৮টি বাগানের হিসাব কয়েকদিনের মধ্যে পাওয়া যাবে।” এর আগে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সবগুলো বাগান থেকে মোট ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৮ হাজার কেজি চা উৎপাদনের তথ্য এসেছিল। সে হিসেবে ডিসেম্বর মাসে ১৩০টি বাগানে আরো ৬৬ লাখ ৫২ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশের মূলত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চায়ের মৌসুম। ডিসেম্বরে উৎপাদনের পরিমাণ কমতে শুরু করে। বছরের শুরুতে চায়ের উৎপাদন থাকে কম। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনা অনুসারে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কারণেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। “২০২১ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাগানগুলোর দিকে নজর দিই। আমাদের বাগানগুলো অনেক পুরাতন। তাই পুরনো গাছ সরিয়ে নতুন চারা রোপন এবং বাগানের পরিমাণ আড়াই শতাংশ করে বাড়ানোর নির্দেশনা দিই।” সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়েছে জানিয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, “পাশাপাশি অবৈধভাবে প্রবেশ করা চা যাতে দেশের বাজারে না আসে সেজন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং অকশনের অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছি। এতে সব তথ্য সাথে সাথে জানতে পারছি। “পাশাপাশি চায়ের মান বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও সমতলে চা চাষের জন্য প্রণোদনা, বিনামূল্যে চারা বিতরণ ও প্লাকিং মেশিন দেওয়া হয়েছে। তাতে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ের চা চাষিরা স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন।” ১০ কোটি কেজির এই মাইলফলক অর্জন চা বাগানের শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষি, বড় বাগান মালিকসহ সকলের সমন্বিত চেষ্টার ফল বলে মনে করেন চা বোর্ড চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “দেশে চা চাষের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। এই পরিমাণ চা না হলে তা বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করতে হত। এখন আমদানি অনেক কমেছে। এটাও বিবেচনায় নিতে হবে।”
চাহিদা কমছে, দামও কম
বার্ষিক চা উৎপাদন রেকর্ড ছাড়ালেও বাগান মালিকরা খুশি নন। দেশের বাজারে চায়ের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়া, নিম্নমানের চা এবং নিলামে দাম কম পাওয়া- এই তিন কারণে শঙ্কায় আছেন তারা। বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি হল, প্রতি নিলামে ৫০ শতাংশের মত চা অবিক্রিত থাকছে। এবং নিলামে চায়ের দাম খুবই কম। এতে বড় বাগানগুলো হয়ত আরো কয়েক বছর টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু বহু বাগান চলতে পারবে না। দীর্ঘমেয়াদে বড় বাগানগুলোও ক্ষতির মুখে পড়বে। “কিছু ট্রেডার বলছেন, দেশের বাজারে চায়ের চাহিদা কমেছে। এর জন্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি বা বিশ্বমন্দার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সব কিছুর দাম বাড়ছে আর চায়ের দাম কমছে। প্রতি কেজি চা উৎপাদনে এখন খরচ পড়ছে ২৩০-২৪০ টাকা। আর নিলামে গড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা কেজিতে।” চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশের বাজারে ৯ কোটি ৩৩ লাখ কেজি চায়ের চাহিদা ছিল। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা কমে ৮ কোটি ৮৪ লাখ কেজি হয়। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (নভেম্বর পর্যন্ত) চাহিদা ছিল ৫ কোটি ৫ লাখ কেজি। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, “বাজারের নিয়মই হল সরবরাহ বেশি হলে দাম একটু কমে। যারা বিপণনের সাথে জড়িত, তারাও বলছেন চায়ের চাহিদা কিছুটা কম। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে চায়ের চাহিদা হয়ত কমেছে। “এবার নির্বাচনের সময়ও চায়ের বিক্রি প্রত্যাশিত বাড়েনি। দেশে বছরে গড়ে ৯ কোটি থেকে সাড়ে ৯ কোটি কেজি চায়ের চাহিদা আছে।” চায়ের নিম্নমুখী বাজারকে স্বাভাবিক করতে রপ্তানি বৃদ্ধিতে পথ খুঁজছে চা বোর্ড।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, “এ বছর রপ্তানিও বেড়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। দুবাই-ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে বাজার ধরতে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। আরো বেশি রপ্তানি করা গেলে স্থানীয় বাজারে চায়ের দামের সমন্বয় হবে। “রপ্তানি বাড়াতে আমরা ৪ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ দিচ্ছি। বিদেশিদের সাথে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। যাতে তাদের চাহিদা ও মানসম্পন্ন চা বাগানে উৎপাদন হয়।” বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান মনে করেন, উত্তরবঙ্গের (সমতলের চা বাগান) নিম্নমানের চা নিলামে আসায় বাজারে চায়ের দর কমে যাচ্ছে। “অনেক বেশি চা উত্তরবঙ্গ থেকে আসছে। যদিও মান খুব খারাপ। এর দামও কম। ফলে পুরো মার্কেট পড়ে যাচ্ছে। শুধু উৎপাদন বাড়িয়ে কী হবে, যদি রপ্তানি করতে না পারি? “এই শিল্পের উপর শ্রমিক-মালিকসহ বহু মানুষ নির্ভরশীল। চায়ের দাম কেন পড়ছে তা খুঁজে বের করে ঠেকানো না গেলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে।” চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের মোট চায়ের ১৯ শতাংশ উৎপাদিত হয়েছিল উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোতে। সবচেয়ে বেশি ৪৮ শতাংশ মৌলভীবাজারে, ১৬ শতাংশ হবিগঞ্জে, ১২ শতাংশ চট্টগ্রামে ও ৬ শতাংশ সিলেটে উৎপাদিত হয়েছিল। দেশের ১৬৮টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৪টিই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে সর্বোচ্চ ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৮টি বাগান, রাঙামাটিতে ২টি, খাগড়াছড়িতে একটি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বাগান আছে।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।