[১৮৪০] মৃতপ্রায় মৃৎশিল্প ধরে রেখেছে বাঁশখালীর রুদ্র পাড়ার কারিগর

S M Ashraful Azom
0

 : গ্রামবাংলার অতীতের সংস্কৃতির একটির অন্যতম অংশ মাটির তৈরি শিল্পকর্ম। মৃৎশিল্প অনেক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগই নারী। এদের মৃৎশিল্পী হিসেবেও অভিহিত করা হয়। 

মৃতপ্রায় মৃৎশিল্প ধরে রেখেছে বাঁশখালীর রুদ্র পাড়ার কারিগর
মাটির হাড়ি-পাতিল তৈরির কাজে ব্যস্থ সময় পার করছে কালীপুরের রুদ্র পাড়ার বিশ্বনাথ রুদ্র



এ শিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি। কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন গৃহস্থলি কাজের উপযোগী সামগ্রী তৈরি করে। চাকার সাহায্যে কাদামাটি দিয়ে তৈরির পর কাঁচা অবস্থায় তাতে বিভিন্ন নকশা করা হয়। কখনও আবার পোড়ানোর পর এতে নানা রঙের সমাবেশে ঘটিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ আকর্ষণীয় নকশা আঁকা হয়। ঘর সাজানোর শৌখিন দ্রব্যও কুমাররা তৈরি করে থাকে।


বাঙ্গালী জাতির শতশত বছরের ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। সভ্যতার উৎকর্ষতা ও দিনদিন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ মৃৎশিল্প। বর্তমানে বাজারে প্লাস্টিক সামগ্রীর বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসপত্রের ভীড়ে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশের মৃৎশিল্প। একসময় এদেশীয় সংস্কৃতিতে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের যথেষ্ট ব্যবহার ও কদর ছিলো। গ্রামীণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্তলির ব্যবহার্য জিনিসপত্রের চাহিদা মেটাতো এই মৃৎশিল্প। সহজলভ্য এই শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।


সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলাধীন পূর্ব কালীপুর রুদ্র পাড়া এলাকায় মৃৎশিল্পের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। মৃৎশিল্পকর্মের জন্য সমধিক পরিচিত এ এলাকায় আগের মতো জৌলুস নেই। একটা সময় অর্ধশতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। এখন মাত্র ৭ থেকে ৮টি পরিবার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। এরা বিভিন্ন হাড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন তৈরির কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন। আবার অর্ডারের পন্যও তারা তৈরি করে। পরিবারের নারী সদস্যরাও পুরুষের পাশাপাশি সহযোগী হয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।


লোকশ্রুতিতে জানা যায়, একসময় এই উপজেলা মৃৎশিল্পের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে এসে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেত। এমন এক সময় ছিল যখন, বাংলার ঘরে ঘরে মাটির তৈরির হাড়ি পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, পয়সা জমানোর ব্যাংক, খেলনা, সৌখিন সামগ্রীসহ নানা জিনিসপত্রের ব্যবহার হত। মৃৎশিল্পীরা এই শিল্পের উপর ভিত্তি করে একসময় শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তুলেছিল। তৎকালীন সময়ে দেশের অর্থনৈতিক বাজার চাঙ্গা রাখতে মৃৎশিল্পের কোন বিকল্পই ছিলনা। তবে বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক, বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থের তৈরি হাড়ি-পতিল, খেলনা, সৌখিন জিনিসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিলুপ্তির মুখে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।


এ পেশায় জড়িতরা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পর্যাপ্ত পূঁজির অভাবে অনেক শিল্পী বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই শিল্পকে ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকে পেশার বাইরে কোন কাজ করতে না পেরে এখনো মৃৎশিল্পে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। এক সময় পহেলা বৈশাখী মেলাসহ বছরের অন্যান্য সময়ে অনুষ্ঠিত মেলা পূজা-পার্বনে মাটির তৈরি মনোমুগ্ধকর খেলনা, সৌখিন জিনিসপত্র তৈরিতে বাঁশখালীর বিভিন্ন মেলায় এবং পাড়ায় পাড়ায় মহাধুম পড়ে গেলেও বর্তমানে তা শুধুই স্বপ্ন। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের বণার্ঢ্য সংস্কৃতির এ মৃৎশিল্প।


বাঁশখালীতে কালীপুর রুদ্র পাড়া, কুমোর পাড়া, বাণীগ্রামের সাধনপুর, আনন্দ বাজার, উত্তর চাম্বল, দক্ষিণ চাম্বল এলাকায় এখনো মৃৎশিল্পের তৈরি দৃষ্টি নন্দন মাটির সামগ্রী কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, সরা, মটকা, দৈ পাতিল, মিষ্টির পাতিল, ফুলের টব, জলকান্দা, মাটির ব্যাংক, ঘটি, বাটি, প্রতিমা, বাসন-কোসন, ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি পাওয়া যায়।


কালীপুর রুদ্র পাড়ার মৃৎশিল্পের কারিগর বিশ্বনাথ রৌদ্রের সাথে কথা হলে তিনি জানান, মৃৎশিল্প আমাদের গ্রামিণ বাংলার অন্যতম একটি সংস্কৃতি। আমাদের বাপ দাদারা দীর্ঘ ৭০ থেকে ৮০ বছর পূর্ব থেকেই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। আমাদের এলাকায় শতাধিক পরিবার এ শিল্পকর্মের সাথে জড়িত ছিল। এখনো আমরাও পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে ধরে আছি। বর্তমানে আমাদের এলাকায় ৭/৮টি পরিবার এ কাজে জড়িত। একাজে আমার বয়স ৩০ বছর। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। পড়ালেখা করে শিক্ষিত হয়ে তারা বাবাদের এ কাজ পছন্দ করে না। আমরাও বাপ-দাদার ঐতিহ্য ছেড়ে দিতে পারছি না। হয়তো একটা সময় এ শিল্প হারিয়ে যাবে।


তিনি আরো জানান, 'মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ এটেঁল মাটি। এটেঁল মাটি এখানে খুব সহজলভ্য নয়। অনেক দূর থেকে পাহাড়ী অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে গিয়ে এটেঁল মাটি সংগ্রহ করতে হয়। তবে আমরা আগের মতো আর ব্যাপকভাবে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানাতে সক্ষম নই। যা তৈরি হয় তা পাইকারী বিক্রি করে দিই। আমাদের উৎপাদিত পন্যের ক্রেতা পাশ্ববর্তি উপজেলা আনোয়ারাসহ কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা। এরা এখানে এসেই পাইকারী নিয়ে যায়।


মৃৎশিল্পের আরেক কারিগর মন্টু রুদ্র বলেন' 'এখনো বাঁশখালীর তৈরি শিল্পকর্মের চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে আগের মতো মহাধুমধাম বিক্রি নেই। বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছি। এটা আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা। আমাদের আর্থিক দৈন্যতা ও এটেঁল মাটির অপ্রতুলতা এবং দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে মৃৎশিল্প আজ প্রায় মৃতশিল্পের কাছাকাছি।


স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. লোকমান জানান, 'পূর্বে এখানকার অধিকাংশ পরিবারের লোকজন মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেখানে ৭ থেকে ৮টি পরিবার কোন রকমে মৃৎশিল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। বর্তমানে মৃৎশিল্পের বাজার খুবই খারাপ। শিল্পী না বাঁচলে শিল্প বাঁচে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সরকার এই শিল্পের জন্য আলাদা ব্যাংক ঋণ, সরকারি বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করলে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তা না হলে অচিরেই বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।আমাদের সংস্কৃতির এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারের পৃষ্টপোশকতা দরকার।' 


শেয়ার করুন

সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top