শফিকুল ইসলাম : সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু পাটের সুদিন এখন আর নেই। গেল কয়েক বছর থেকেই পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার পাট চাষিরা।
চলতি বছরে অনাবৃষ্টির কারনে পাটের ফলন যেমন কম হয়েছে, তেমন বেড়েছে খরচও। এ ছাড়া শুরুতেই পাট জাগ দেয়া নিয়েও বিপাকে পড়তে হয়েছে পাট চাষিদের। তবে বর্তমান বাজারে পাটের দাম না থাকায় শঙ্কার মধ্যে দিনপার করছেন পাট চাষিরা। চাষের খরচ তোলা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন তারা। দাম কমে যাওয়ার জন্য চাষিরা সিন্ডিকেটকে দুষছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের কাছে এখনো গত বছরের পাট রয়েছে। এ জন্য পাট ক্রয় করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম।
রৌমারী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলার চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৩’শ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছর পাট চাষের লক্ষমাত্রা ছিল ২ হাজার ১৭৭ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এবার ১২৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ বেশি হয়েছে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাট চাষের সময় এবছর নানা বিড়ম্বনার শিকার হন চাষিরা। প্রথমত, বীজ বপনের সময় খড়া হওয়ায় ঠিকমতো চারা গজায়নি। আবার চারা গজালেও পাতলা হয়েছে। এতে করে ব্যাহত হয়েছে পাটের ফলন। এ ছাড়া শ্রমিকের বাড়তি মজুরি, সেচ, বীজ, কীটনাশক, সারের দাম বৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। অন্যদিকে পাট কাটার সময় পানির অভাবে অনেক কৃষককে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় নষ্ট হয়েছে পাটের রং। চাষিরা বলছেন, এক বিঘা জমিতে হালচাষ থেকে শুরু করে বীজ, সার, কীটনাশক, পানি সেচ, নিড়ানি, কাটা, জাগ দেয়া ও শ্রমিকসহ ঘরে তোলা পর্যন্ত বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ফলন হচ্ছে ১০ থেকে ১৩ মণ। শুরুতে পাটের দাম ২ হাজার ৬’শ টাক মণ থাকলেও বর্তমানে বাজরে ২ হাজার ২’শ থেকে ২ হাজার ৩’শ টাকা মণপ্রতি পাট বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছর এই সময় প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩’শ থেকে ৩ হাজার ৫’শ টাকায়।
রৌমারী উপজেলার রৌমারী’র পাটহাটে গিয়ে দেখা যায়, এই হাটে ভোর থেকেই প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত পাট ভ্যানগাড়ি, সাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে হাটে। এরপর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চলছে তাদের দর-কষাকষি। গড়ে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২’শ থেকে ২ হাজার ৩’শ টাকায়। তবে বাজারে যে দামে পাট বেচাকেনা হচ্ছে তাতে কোনো কোনো চাষিকে পাট বিক্রি করে মোনখারাপ করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। পাট বিক্রি করতে আসা উপজেলার ফলুয়রচর গ্রামের পাটচাষি আজিজুল হক বলেন, এ বছর আমি ৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। খড়ার কারনে আমার ২ বিঘা জমিরপাট মরে গেছে। পরে অন্যের শেলোমেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে ২বিঘা জমির পাটরক্ষা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এবার পাট চাষে অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাবে বাজারে পাটের দাম পাচ্ছি না। দুই বিঘা জমি থেকে ১৫ মণ পাট পেয়েছি। আজকে এই হাটে পাট প্রতিমণ হিসাবে ২ হাজার ৩’শ টাকা বিক্রি করলাম। আপনারাই বলেন, ৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করে কত টাকা লাভ হয়েছে ?
বাগুয়ারচর গ্রামের আব্দুল জোব্বার বলেন, আমরা অনেক পরিশ্রম করে জমি চাষাবাদ করি। কিন্তু বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনে সঠিকদাম পাই না আমরা। আমরা যে রোদে পোড়ে জমিতে চাষ করি এর কোনো মূল্য নেই। সরকার আমাদের দিকে নজর না দিলে সামনের বছর থেকে মানুষ পাট চাষ করা ছেড়ে দেবে।
উপজেলার চরশৌলমারী গ্রামের পাটচাষি জয়নাল আবেদীন বলেন, এবছর আমি ১বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ৭মণ পেয়েছি। খড়ার কারনে প্রথমেই পাটের গাছ মরে গেছে। পাটের চারা শেলোমেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে কোনো রকম রক্ষা করা হয়েছে। এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। পাট পেয়েছি ৭ মণ। আজকে এই হাটে প্রতিমণ ২ হাজার ১’শ টাকা হিসাবে পাটবিক্রি করলাম। আমার ৭মণ পাটবিক্রি করে টাকা হয়েছে ১৪ হাজার ৭’শ টাকা। এতে করে আমাদের কয় (কত) টাকা লাভ হবে বলেন।
রাজিবপুর উপজেলা থেকে পাট বিক্রি করতে আসেন আবুল হোসেন তিনি বলেন, আমি এ বছর দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ৭মণ করে পাট পেয়েছি। অনাবৃষ্টির কারনে ফলন কম হয়েছে। এ ছাড়া পানির অভাবে সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় কালার নষ্ট হয়ে গেছে। একে তো কালার নষ্ট হয়ে গেছে এর মধ্যে আবার বাজারে পাটের দাম খুবই কম। রৌমারীর ব্যবসায়ীরা অন্য জেলার পাট ব্যবসায়ীদের এলাকায় আসতে বাধা সৃষ্টি করে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট তৈরী করে কম দামে পাট কিনে। আমরা কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাই না।’
ইজলামারী গ্রামের জায়দুল ইসলাম নামে এক পাট ব্যবসায়ী বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ বছর থেকে পাটের ব্যবসা করি। এখান থেকে পাট কিনে জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকি। মোকামে বেচাকেনা না থাকায় পাটের দাম কমে গেছে। আগামীতে দাম বাড়বে কি না, বলা যাচ্ছে না।
নুর ই আলম নামের ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫’শ টাকা পর্যন্ত প্রতিমণ হিসাবে অনেক পাট কেনা আছে। সেই পাটই বিক্রি করতে পারি নাই। মিলারদের পাট দিলে তারা টাকা দিতে চায় না। আমাদের মতো ব্যসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরাও চাই সরকার বাজার তদারকি করুক।
জাহিদুল ইসলাম জাহিদ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের পাটই এখনো বিক্রি করতে পারিনি। পাট কেনার পর থেকেই পাটের দাম কমে গেছে। এ বছর টাকা না থাকায় পাট কিনতে পারছি না। বাজারে এসে শুধু ঘোরাফেরা করি। এমনিতেই দুই তিন বছরের পাট কিনে লসে রয়েছি।
রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৩’শ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছর পাট চাষের লক্ষমাত্রা ছিল ২ হাজার ১৭৭ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এবার ১২৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ বেশি হয়েছে। তবে পাটের বীজ বপনের সময় বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারনে কৃষকরা সঠিক সময়ে জমিতে পাটের বীজ বপন করতে পারেনি। এ ছাড়া পাট কাটার সময় পানির অভাবে জাগ দেয়ার যে সমস্যা, সেই কারনে কৃষকরা পাট চাষ করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে পাটের ফলনে কোনো বিপর্যয় ঘটেনি।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।