[৮৯৭] পবিত্র আশুরার ফজিলত ও নবী পরিবারের মর্যাদা-ভালোবাসা

S M Ashraful Azom
0

: আজ বছরের মুহররম মাসের ৮ তারিখ। আগামী শনিবার (২৯ জুলাই) সারা দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হবে। কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদত বরণের শোকাবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পালিত হয় আশুরা। 

পবিত্র আশুরার ফজিলত ও নবী পরিবারের মর্যাদা-ভালোবাসা



আশুরার পরিচয়ঃ


আশুরা শব্দটি আরবি, এটা 'আশারুন বা আশেরুম' থেকে নির্গত। আভিধানিক অর্থ হলো দশম। শরিয়তের পরিভাষায় মুহররম মাসের দশম তারিখকে আরো বলা হয়। মুহররমের দশম তারিখকে “আশুরা দিবস" নামকরণ করার পিছনে কিছু বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়।


নামকরণের কারণ বা প্রেক্ষাপটঃ

ক. রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতদেরকে আল্লাহ্ তা'আলা বিশেষ ফজিলত পূর্ণ যে দশটি দিন দান করেছেন তন্মধ্যে আশুরার দিনের অবস্থান ১০ম নম্বরে হওয়ার কারণে এটাকে “ইয়াওমে আশুরা" বা আশুরা দিবস বলা হয়।

খ. আত্তরা দিবসের নামকরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় মুহররমের ১০ তারিখে রহমত ও বরকত মন্ডিত ১০ টি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বিধায় আশুরা করে নামকরণ করা হয়েছে ।

গ. তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে “যেহেতু এ দিনটি মহররমের দশ তারিখ সেখান থেকেই এর নামকরণ “ইয়াউমে আশুরা "করা হয়েছে। এ দিবসটি পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে বিভিন্ন কারণে সম্মানিত ও বরকতমণ্ডিত।


এ দিবসে যে সমস্ত ঘটনাবলী রয়েছে তন্মধ্যে সমগ্র বিশ্বে সাড়া জাগানো নজীরবিহীন ও হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনা হলো ৬১ হিজরির মুহররম মাসের ১০ তারিখে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন- ইসলামকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে সজীব রাখতে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তে আমাদের প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)'র নয়নমনি হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুসহ ৭২/৮২ জন আহলে বাইতে রাসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে দুষ্ট ও পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের জালেম বাহিনীর হাতে শাহাদাতের ঘটনা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে আজও । নামকরণের প্রেক্ষাপট হতে আশুরার ফজিলত এবং তাৎপর্য কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়।


আশুরার ফজিলতঃ

আশুরা দিবসের ফজিলত অপরীসীম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে রোযা রাখলো আল্লাহ্ তা'আলা তার আমলনামায় দশ হাজার ফেরেশতার নেক আমলের সওয়াব দান করবেন। তাঁর আমলনামায় দশ হাজার শহীদ ও দশ বছর ইবাদতের সওয়ার দান করবেন । জাহিলিয়াতের যুগেও কুরাইশগণ এই দিবসে রোযা রাখতেন, হিজরতের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ দিবসে রোযা পালন করতেন। আর হিজরতের পরও এ দিবসে রোযা রাখা ফরয ছিল। পরবর্তীতে রমযানের এক মাসের রোযা ফরয হওয়ার হুকুম নাজিল হলে আশুরা দিবসে রোযা রাখার ফরজিয়্যাতের হুকুম রহিত/স্থগিত হয়ে যায়। তবে আশুরা দিবসের রোয়া রাখা সুন্নাত, মুস্তাহাব ও মাসনুন হওয়ার ফজিলত ও সওয়াব বিদ্যমান আছে ।


হাদিসে পাকে আরো এসেছে “যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে রোযাদারকে ইফতার করালো, সে যেন সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ইফতার করালো। আর যে ব্যক্তি সহমর্মিতার সাথে কোন ইয়াতিম সন্তানের মাথায় হাত রাখলো এর পরিবর্তে জান্নাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে।


হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি। ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বনী ঈসরাঈলের উপর সারা বছরে শুধু আশুরা দিবসের রোযা ফরয করা হয়েছিল। সুতরাং তোমরাও সেদিন রোযা রাখ আর পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় কর। যে ব্যক্তি ঐ দিন উদার হস্তে খরচ করবে আল্লাহ্ তা'আলা সারা বৎসর সুখ স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপনের তাওফিক দান করবেন । আর তার চল্লিশ বৎসরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আশুরা রজনীতে সারা রাত ইবাদত করে পরবর্তী দিন রোযা রাখবে তার মৃত্যু বা যন্ত্রণা অনুভব হবে না।


তাই আশুরার দিন রোযা রাখা, নামায পড়া, সদকা- খায়রাত করা, কারবালার শহীদদের স্মরণে কোরআন খানীর ব্যবস্থা করা, ফাতিহা খানী করা, মিলাদ- মাহফিল, যিকর-আযকার ও আলোচনা সভা ইত্যাদি করা অতি ফজিলত ও পুণ্যময় আমল এবং সওয়াব লাভের অন্যতম ওসিলা। হযরত নিযাম উদ্দীন আউলিয়া মাহবুবে এলাহী কুদ্দিসা সিররুহুর হযরত বাবা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকারের বরাতে বর্ণনা করেছেন, “আশুরার এ মহান দিবসে ইবাদত- বন্দেগী, কোরআন তেলাওয়াত, নামায-কলমা ও দুরূদ শরীফ পাঠ ব্যতীত অযথা দুনিয়াবী বাজে কাজে লিপ্ত বা মশগুল হওয়া উচিত নয় । [সূত্র -গুনিয়াতুত্ তালেবীন কৃত- বড়পীরৃ গাউসে আ'যম শেখ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও যুগ-জিজ্ঞাসা ইত্যাদি |


♦ আহলে বাইত কারাঃ-

দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আমরা মুসলমান হয়েও আহলে বাইত তথা আউলাদে রাসূলকে চিনি না বা চেনার চেষ্টাও করি না। আবার কোন সময় চিনলেও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করি না। এটা কি আমাদের জন্য লজ্জার নয়? বস্তুত আহলে বাইত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় ও স্নেহের পাত্র। সেদিকে নির্দেশ করেই রাব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআনুল করীম এরশাদ ফরমান-

(হে হাবীব) আপনি বলে দিন যে, আমি (রাসূল) তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাই না, আমার বংশধরগণ ও নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা ব্যতীত। [সূরা শুরা-২৩] এই আয়াতে কারীমা নাযিল হওয়ার পর, সাহাবায়ে কেরাম রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিকট স্বীয় আত্মীয় সম্পর্কে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকটাত্মীয় কারা? যাঁদের প্রতি (আমাদের) আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব।  [তাফসীর ইবনে কছীর- ২য় খণ্ড, ২১১ পৃষ্ঠা]


সরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- তাঁরা (আহলে বাইত) হলেন হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়ালাহু তা‘আলা আনহুম এবং তাদের উভয়ের আওলাদ।  [যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব, সাওয়াইক্বে মুহরিক্বা, খুৎবাতে মুহররম- পৃষ্ঠা২৫৬, মুফতি জালালুদ্দীন আমজাদী রহ.]


কুরআনে তাঁদের সম্মানঃ

বস্তুত আহলে বাইত ছিলেন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খুবই আপনজন। পবিত্র ক্বোরআনে তাদের পবিত্রতা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ্ পাক তাঁদের সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন- ‘‘হে আহলে বাইত! নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। [সূরা আহযাব: ৩৩]


আয়াতটি নাযিল হলে হযরত আবু সাঈদ খুদরী, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা ও উম্মে সালমা (রাদ্বিয়ার্লাহু আনহুম) বলেন, এটি ‘‘আহলে বাইত’’ তথা মা ফাতেমা, হযরত আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয়ে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং তাবেঈ হযরত মুজাহিদ, হযরত ক্বাতাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা সহ অন্যান্য মুফাসসিরের মতে আহলে বাইত বলতে ‘‘আহলে আবা’’ অর্থাৎ চাদরাবৃতদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো কারা এই চাদরাবৃত? এই প্রসঙ্গে একটি হাদীস শরীফে এসেছে- হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যুষে বের হলেন, তখন তাঁর শরীর মুবারক কালো নকশা বিশিষ্ট চাদর দ্বারা আবৃত ছিল। অতঃপর ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আসলে নবীজী তাঁকে চাদরের মধ্যে শামিল করে নিলেন, এরপর ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এলে তাঁকেও নবীজী চাদর মুবারকে জড়িয়ে নিলেন। অতঃপর আসলেন হযরত মা ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আল্লাহর রসূল তাঁকেও চাদরের অভ্যন্তরে নিয়ে নিলেন। সর্বশেষ এলেন শেরে খোদা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তাঁকেও তাঁর নূরানী চাদর মুবারকে প্রবেশ করিয়ে নিলেন। অতঃপর তিলাওয়াত করলেন- হে আহলে বাইত! নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।  [সূরা আহযাব-৩৩]


অতঃপর রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই দোয়া করলেন- আল্লাহুম্মা হা-উলায়ে আহলু বাইতি ওয়া খাচ্ছাতি ফাআজহিব আনহুমুর রিজসা ওয়া তাতহিরহুম তাতহীরান। অর্থাৎ হে আল্লাহ্! এরাই আমার আহলে বাইত এবং বংশীয় ও ঘনিষ্ঠজন। আপনি এদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করুন আর এদেরকে পরিপূর্ণভাবে পবিত্র করুন [সহীহ মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৬৮]


অপর এক হাদীসে পাকে এসেছে- হযরত উসামা ইবনে যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, ‘‘আমি নবীজীর খিদমতে উপস্থিত হয়ে দেখলাম নবীজী এমনভাবে কম্বল জড়িয়ে আছেন যে, মনে হলো তার ভিতরে কিছু লুকিয়ে রেখেছেন। আমি আবেদন করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, কম্বলের ভিতরে কী যেন লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছে? সাথে সাথে নবীজী কম্বলখানা খুলে দিলেন। তখন দেখা গেল নবীজীর নূরানী কোলে বসে আছেন ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়ালাহু তা’আলা আনহুমা। অতঃপর নবীজী ইরশাদ করলেন- আলাহুম্মা ইন্নি উহিব্বুহুমা ফাআহিব্বাহুমা ওয়া আহিব্বা মান আহাব্বাহুমা। অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমি এই দু’জনকে ভালোবাসি সুতরাং তুমিও এদেরকে ভালোবাস এবং ভালোবাস তাদেরকে যারা এদেরকে ভালোবাসবে। [ তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৭০]


অতএব, প্রতীয়মান হলো যে, আহলে বায়ত হলো শেরে খোদা আলী, হযরত মা ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও তাঁদের সন্তানগণ।  আহলে বাইতে রাসূল’র মর্যাদা যবেহ ইসমাঈল যে যিবহে আযীম দ্বারা পরিবর্তন হয়, তা হুযূর নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএর আবির্ভাবের পর পূর্ণতা লাভ করে।


এ প্রসঙ্গে ড.আল্লামা ইকবাল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘‘সিরের ইবরাহীম ইসমাঈল বুয়দ ইয়া’নি ইসমাঈল রা তাফসীলে বুয়দ।’’ অর্থাৎ ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর সেই কোরবানির ঘটনা ছিল এক গূঢ় রহস্য, আর তার প্রাকটিক্যাল নমুনা হলো কারবালার যমীনে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর শেরে খোদা হযরত আলী ও নবী দুলালী মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর বংশ অব্যাহত থাকে। সেই শাহাদাত সংঘটিত হওয়ার সময় যাকে যবেহ ইসমাঈল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ কারবালার ময়দানের ঘটনা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর আহলে বাইত তথা আউলাদে রাসূলগণকে আল্লাহ্ তা‘আলা যে মর্যাদা দান করেছেন তা সাধারণ মুমিন মুসলমানদের দেয়া হয়নি। কারণ তাঁরা আল্লাহর রাসূলের বংশধর।


তাঁদের মার্যাদা সম্পর্কে হাদীস শরীফঃ


ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে আল্লাহর রাসূল নিজের পুত্রের মত ভালোবাসতেন।


১) হাদীসে পাকে এসেছে- হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি দেখেছি, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের হাত ধরে বলেছেন- এরা আমার সন্তান।  [দায়লামী আল্ ফিরদাউস বিমা’ সূরিল খিতাব-৪/৩৩৬ হাদীস ৫৯৭৩]


২) হযরত ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার সাদৃশ্য হাদীসে পাকে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তাঁরা সবচেয়ে বেশী সাদৃশ ছিলেন।  [আসকালানী, আল্ ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা ২/৭৭ হাদীস ১৭২৬] 


৩) তাবরানী শরীফের এক হাদীসে পাকে রয়েছে- হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বক্ষ থেকে মাথা মুবারক পর্যন্ত, আর ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন বক্ষ থেকে পা মুবারক পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পুরোপুরি সাদৃশ। [আল্ মুজামুল কবির, ৩/২৯ হাদীস ২৫৭]


৪) আহলে বাইত সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত বংশের অধিকারী নবী-বংশ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। এ প্রসঙ্গে হাদীস পাকে এসেছে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর আউলাদগণের মধ্যে কেনান গোত্রকে নির্বাচন করেছেন। তার মধ্য থেকে কোরাইশ বংশকে আর কোরাইশ বংশ হতে বনী হাশেমকে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বনী হাশেম হতে আমাকে মনোনীত করেছেন।  [বরকাতে আলে রাসূল: পৃষ্ঠা ৯১, খুৎবাতে মুহররম পৃষ্ঠা ২৪৩]


৫) উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- একদিন জিবরাঈল আমীন এসে আমাকে বললেন- আমি জমিনের পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত সবখানে তালাশ করলাম, কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে উত্তম মর্যাদাবান সম্মানিত কাউকে খুঁজে পাইনি। তাবরানী শরীফে ও দারু কুতনীর মধ্যে উলেখ রয়েছে- রাসূলে পাক ইরশাদ করেছেন-কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সর্ব প্রথম ‘আহলে বায়ত’ এর জন্য আমার শাফা‘আত হবে; অতঃপর অন্যান্যের জন্য। আল্লাহর নবী ইরশাদ করেন, ‘‘আমি যাদের জন্য/যার জন্য সর্বপ্রথম সুপারিশ করব। তারাই সর্বাধিক মর্যাদাবান হবে।’’  [আশরাফুল মুয়াববাদ: পৃষ্ঠা ৩৯] 

এ সব হাদীসে পাক থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আহলে বাইত অতি মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন। 



আহলে বায়তের প্রতি মুহাব্বত বা ভালবাসাঃ

আহলে বাইতের প্রতি মুহাব্বত বহু হাদিস শরিফে বিদ্যমান। তৎমধ্যে

১) জামে তিরমিযী শরীফে উলেখ রয়েছে- হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিদায় হজের সময় আরাফাত দিবসে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘ক্বাসওয়া’ নামক উটের উপর আরোহনরত অবস্থায় বলতে শুনেছি ও দেখেছি- নবীজী ইরশাদ করলেন- হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর তাহলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো কিতাবুল্লাহ্ ও আমার বংশধর- আমার আহলে বাইত। [মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ৫৬]


২) তাবরানী শরীফে এসেছে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন বান্দা মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে নিজের জীবন থেকে, আমার বংশধরকে তার বংশধর থেকে, আমার পরিবার-পরিজনকে তার পরিবার-পরিজন থেকে এবং আমার সত্তাকে তার সত্তার চাইতে বেশি ভালোবাসবে না। আউলাদে রাসূলকে যে যত বেশি ভালোবাসবে ও সম্মান করবে সে তত বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে।


৩) হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হাসান-হোসাইন আলায়হিমাস্ সালামকে ভালোবেসেছে, সে যেন বাস্তবে আমি রাসূলকে ভালোবেসেছে। [ইবনে মাজাহ আস্ সুনান, ইমাম আহমদ- আল্ মুসনাদ, নাসায়ী- আস্ সুনানুল কুবরা ও ফাযায়িলুস সাহাবা। যথক্রমে হাদীস ১৪৩,৭৮৬৩,৮১৬৮ ও ৬৪]


আর যাকে আল্লাহর রাসূল ভালোবেসেছেন, আল্লাহ্ও তাঁকে ভালোবাসবেন। সুতরাং আল্লাহ্ যাকে ভালোবাসবেন নিঃসন্দেহে তিনি তাঁকে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।


৪) হাদীস পাকে এসেছে- হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হযরত রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসবে তাকে আমি ভালোবাসবো, আর যাকে আমি (নবী) ভালোবাসবো, তাকে আল্লাহ্ পাক ভালোবাসবেন, আর আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন যাকে ভালোবাসেন তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যা নেয়ামত দ্বারা পরিপূর্ণ।  [তাবরানী: আল্ মু’জামুল কবীর ৩/৫০ হাদীস ২৬৫৫ হায়সমী: মাজমাঊয জাওয়ায়েদ ৯/১৮১]


এমনকি দুনিয়ার শেষ পরীক্ষা অর্থাৎ মৃত্যুর পরীক্ষায় ও আউলাদে রাসূলের নেগাহে করমে ও দোয়ার বরকতে সফলতা লাভ করা যাবে, যা আল্লাহর রাসূলের একাধিক হাদীসে পাক দ্বারা সুস্পষ্ট।

৫) রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নবী বংশের ভালোবাসায় ইন্তেকাল করলো, সে যেন ক্ষমাপ্রাপ্ত অবস্থায় ইন্তেকাল করল এবং আর যে ব্যক্তি নবী বংশের ভালোবাসা নিয়ে ইন্তেকাল করলো সে যেন তাওবাকারী রূপে ইন্তেকাল করল। এবং যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধরদের ভালোবাসার উপর ইন্তেকাল করলো, সে যেন মু’মিন হিসেবে ইন্তেকাল করলো। [খোতবাতে মুহাররম: ১৪১]


আহলে বায়ত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামঃ


১) আহলে বাইতের মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, (যার হাতে আমার প্রাণ এ সত্তা, তাঁর কসম) আমার নিকট আমার আত্মীয়গণ অপেক্ষা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আত্মীয় ও বংশধরের ভালোবাসা অধিক প্রিয়। [বুখারী শরীফ ও আশশারফুল মুআব্বদ : পৃষ্ঠা ৮৭]


২) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়ালাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আলে রাসূলকে মহব্বত করা একশ বৎসর ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। [আশশারফুল মুআব্বাদ: পৃষ্ঠা ৮৭]


৩) শাফেয়ী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমি আহলে বাইতে রাসূলকে এতবেশি ভালোবাসতাম যে, লোকেরা আমাকে রাফেযী বলা শুরু করল। আমি তাদের জবাবে বললাম, আলে রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নাম যদি রাফেযী হয়, তাহলে হে জ্বিন জাতি ও মানবজাতি ও বিশ্ববাসী সাক্ষী হয়ে থাক, এই অর্থে আমি রাফেযী। এরপর আহলে বাইতের মহব্বতে তিনি আরো বলেন, হে নবীজীর বংশধরগণ, আপনাদের মহব্বত করা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয। আর এই হুকুম মহান আল্লাহ পবিত্র ক্বোরআনে নাযিল করেছেন।

তদ্রুপ তাঁদের সাথে যারা শত্রুতা পোষণ করবে তারা মূলত আল্লাহ্ ও রাসূলের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- " আল্লাহর ক্রোধ অতীব কঠোর ও কঠিন হবে যারা আমার বংশধরকে কষ্ট দিয়েছে।


৫)মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন- " যে আমার বংশধরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, সে আমার সাথেই বিদ্বেষভাব পোষণ করল। হোসাইন আমার থেকে আমি হোসাইন থেকে, যে হোসাইনকে ভালোবাসে তাকে মহান আল্লাহ্ ভালোবাসেন। [তিরমিযি শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮২]


★ হাদিসটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুনঃ


একদা নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযরত ছিলেন। ইমাম হোসাইন নিজ ঘর হতে বের হয়ে মসজিদে নববীতে গেলেন এবং দেখতে পেলেন নানাজান রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে নামাযরত। শিশু ইমাম হোসাইন কালবিলম্ব না করে আল্লাহর রাসূলের কাঁধ মুবারকে ওঠে গেলেন। হুযূর-ই আকরাম সাজদাকে দীর্ঘ করে দিলেন। রাসূলুল্লাহরও ইচ্ছা ইমাম হোসাইন যতক্ষণ নিজের ইচ্ছায় নামবে না ততক্ষণ অবস্থান করুক। এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অবতরণ করলে সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও মাথা মুবারক সিজদা হতে উত্তোলন করলেন। নামায শেষে সাহাবীরা সিজদা দীর্ঘ করার কারণ জানতে চাইলেন এবং বললেন আজ থেকে কি সিজদা দীর্ঘ করার কোন হুকুম এসেছে? হে আল্লাহর রাসূল! হুযূর-ই আকরাম উত্তরে বললেন, ‘না, সিজদা দীর্ঘ করার কারণ- আমার হোসাইন আমার কাঁধে উঠে গিয়েছিল। আর সে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়ার আশঙ্কায় আমি সিজদা দীর্ঘ করি। [মুস্তাদরাক: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠ ১৬৬]


হযরত  ইমাম হোসাইনের এতটুকু কষ্টও নবীজী সহ্য করতে পারলেন না, তাও আবার নামাযরত অবস্থায়। তাহেল ৬১ হিজরি সনে করবালার প্রান্তরে কুখ্যাত ইয়াযীদের নরপশুরা সেই ইমামের নূরানী দেহ মুবারকে কত ধরনের নির্যাতন চালিয়ে পরিশেষে দেহ মুবারক হতে মাথা মুবারককে বিচ্ছিন্ন করে উল্লাস করেছিল কারবালার দিন ! (নাঊযুবিলাহ্)। এতে নবীজী কত কষ্ট পেয়েছেন তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। 

পরিশেষে, বর্তমানে এক শ্রেণীর লোক আশুরার নামে যে মাতম করে ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ছুরিও বেড দিয়ে শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তা মোটেও ইসলাম ও শরিয়ত সমর্থিত নয়। তাই সকল প্রকার কুপ্রথা মর্সিয়া, মাতম বর্জন করে শাহাদাতে কারবালার প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। কাজী নজরুল ইসলাম কারবালার চেতনা ও শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন- ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দ চাহিনা।।


তাইতো বলা ‘‘ ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ।’’ আমাদের সকলের অন্তরে যেন আহলে বাইতে রাসূলের প্রতি মহব্বত ও সম্মান বিরাজমান রাখতে পারি আল্লাহ তাআলা  সেই তাওফীক্ব দান করুন। আ-মী-ন।                    



লেখকঃ
মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদদীন
মুদাররিস- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
খতিব- জামে মসজিদে রহমানিয়া গাউসিয়া, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম। 

শেয়ার করুন

সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top