সেবা ডেস্ক : সারাদিনের ক্লান্তি ভুলতে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় আমরা একত্রিত হই। চা-চু খাই। সুখ-দু:খ ভাগাভাগি করি। আলাপের বিষয় ঘুরেফিরে একই; সেই "আটপৌরে জীবনের গল্প"। কেউ বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান রেখে এসেছেন; কারো বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা; যারা প্রতীক্ষা করছেন কবে সন্তান টাকা পাঠাবেন। আড্ডায় অংশগ্রহণকারী আমরা প্রায় সবাই শিক্ষক।
প্রত্যেকেই উপজেলার ভিন্ন ভিন্ন এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। কেউ সুদুর উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছেন, কেউ ময়মনসিংহ থেকে আবার কেউ হয়ত দিনাজপুর থেকে। একেক জনের বাড়ি একেক জেলায় হলেও সবার দুঃখ প্রায় একই; না পাওয়ার দুঃখ।
এভাবে যে আর চলছে না। কেউ মাসে বেতন পান সাড়ে ১২ হাজার টাকা আবার কেউ ১৬ হাজার টাকা। এ টাকা থেকে ঘর ভাড়া দিতে হয়, খাবারের টাকা দিতে হয়, স্কুলে যেতে-আসতে ভাড়া লাগে। মাসিক কিছু খরচের টাকাও রাখতে হয়। কয় টাকাই আর বাকী থাকে। অথচ নিয়ম করে প্রতিমাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। নতুবা অভুক্ত থাকতে হবে বৃদ্ধ মা-বাবা কিংবা সন্তানাদিকে।
কি অদ্ভুত জীবন আমাদের! সুন্দর পোষাক পড়তে হয়, সুন্দর করে কথা বলতে হয়। শ্রেণিকক্ষে সবসময় হাসিখুশি থাকতে হয়। অথচ পরানের গহীনে কেবলই হাহাকার, কেবলই শূন্যতা! সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সেই পঙক্তিমালা যেন আমাদেরই জীবনালেখ্য। প্রিয়তমাসু'তে তিনি লিখেছেন- "আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায় রাজপথে- পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দু:সহ অন্ধকার।"
আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত স্বপ্নের কথা বলি। মানবিক মানুষ হওয়ার উপদেশ দেই। আদর্শবান হওয়ার গল্প শোনাই। অথচ দু:স্বপ্ন আমাদের তাড়া করে ফিরে সবসময়।
এতো বঞ্চিত, এতো বৈষম্যের পরও কিন্তু আমরা আলো জ্বালাই, আমরা আলোকিত সমাজ গড়ি। কারণ শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা মুখ আমাদের সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। এটাই কি আমাদের দুর্বলতা? জানি না। হয়ত বা।
ক্লান্তশ্রান্ত একজন চালকের দ্বারা যেমন দুর্ঘটনার সমুহ সম্ভাবনা থাকে; আবার অসুস্থ একজন শিল্পীর কাছ থেকে যেমন মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত প্রত্যাশা করা যায় না।
বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরও হয়েছে একই অবস্থা। দারিদ্রকে সঙ্গী করে কীভাবে আমরা সামনে এগুতে পারি, বলতে পারেন?
কেন আমাদেরই সাথে এতো বৈষম্য, জানি না। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদই দিলাম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকান। তাদের শিক্ষকদের বেতন দেখুন। ভুটানের শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থা পরিলক্ষিত করুন। একজন শ্রমিকের দৈনিক আয় ৫'শ টাকা। মাসে ১৫ হাজার টাকা। অথচ...। শিক্ষকদের এই মানবেতর জীবনাচরণে অপমানে, লজ্জায় সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের শিওরে উঠার কথা। অথচ আমরা রাজপথে রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে অনশন করছি জাতীয়করণের। একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এ লড়াই। আমরা জানি আমাদের ভবিষ্যৎ কী? অথচ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীকরণ হলে কেবল শিক্ষকরাই সুবিধা পাবেন, এমনটি কিন্তু নয়। বরং দেশের বেশীরভাগ মানুষ উপকৃত হবেন। কারণ, ৯৮‰ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রায় ৬ লক্ষ শিক্ষক কিছুটা উন্নত জীবনের আশায় চেয়ে আছে সরকারের দিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই এখন আমাদের শেষ ভরসার স্থল।
প্লিজ, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না, উন্নয়নের সহযাত্রী ভাবুন। আমরা বিচ্ছিন্ন কেউ নই, আমরা এদেশের মানুষ। আমাদেরও ইচ্ছে হয় সুন্দর করে বাঁচার। আমাদেরও ইচ্ছে হয় মা-বাবা আর প্রিয়জনদের মুখে একটু হাসি ফোটাই।
সহকারী শিক্ষক, পুটিজুরী শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়
বাহুবল, হবিগঞ্জ।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।