মো. শাহ্ জামাল, জামালপুর সংবাদদাতা : স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও, জামালপুরের মেলান্দহে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ নেই। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর আলম কোম্পানির টুআইসি আব্দুল করিম মেম্বারের নেতৃত্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মেলান্দহকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়। তার আগে মেলান্দহের মাহমুদপুর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সমর, রমিজ উদ্দিন শহীদ হন। বন্দি হন আরো কয়েক মুক্তিযোদ্ধা।
এটি ছিল মেলান্দহের ইতিহাসে সর্বশেষ এবং বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধচলাকালে জামালপুর-মেলান্দহ সীমান্তবর্তী ঝিনাই ব্রিজ, বেতমারি রেলওয়ে ব্রিজ, দাগি-বানিপাকুরিয়া রেলওয়ে ব্রিজ, সিও’র অফিস ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পগুলো থেকে পাকবাহিনীরা বিভিন্ন দিকে যুদ্ধ করতো। বহু নারী-পুরুষকে এই ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন-হত্যা করা হয়।
তৎকালের ছাত্রলীগ নেতা একাধারে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাহাঙ্গীর আলম বাবুর বলেন, বাংলাদেশ ম্যাপ খচিত দেশের বিভিন্ন স্থানে পতাকা উত্তোলন হয়। ৯ মার্চ আমিও কয়েক ছাত্র-যুকদের নিয়ে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মেলান্দহ টিটিডিসি প্রথম গেরিলা ট্রেনিং শুরু করি। পরে আব্দুল হাই বাচ্চু মিয়ার নেতৃত্বে উমির উদ্দিন পাইলট স্কুল মাঠে, তৎকালিন মুজাহিদ কমান্ডার আহাম্মদ আলী নোটনের নেতৃত্বে কলাবাধা হাই স্কুল মাঠে এবং নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে জালালপুর স্কুল মাঠে গেরিলা ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সংঘবদ্ধ করা হয়। উমির উদ্দিন স্কুল মাঠে দু’টি গ্রæপের ট্রেনিং করান যথাক্রমে বাঘাডোবার সুলতান পুলিশ, দেওলাবাড়ির মজনু মিলিটারি। নূরুল ইসলাম পরে পাকবাহিনীর দলে চলে যান।
জামালপুর-শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সফল অপারেশনে অংশগ্রহণকারি আবুল হোসেন জানান- রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দলের অভিযান চলে। সর্বশেষ অভিযানে যাই ফুলছেন্নার আমি, মজিবুর রহমান ফারাজী, ঘোষেরপাড়ার, আসাদুল্লাহ (পরে কমান্ডার হন), আবদুল কুদ্দুস, ইসলামপুরের মানিকুল ইসলাম মানিক (পরে কমান্ডার হন), চন্দ্রার আলম এবং দিগপাইতের রইচ উদ্দিন। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধচলাকালে জামালপুর-শেরপুরের প্রথম সফল অপারেশন। যা বিবিসি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে সম্প্রচার হয়। এই অপারেশন সফল করতে আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎকালিন আওয়ামী লীগ নেতা রুস্তম আলী কন্ট্রাক্টর দিকনির্দেশনা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে মাদারগঞ্জ বইয়ের লেখক, দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা জাহিদুর রহমান উজ্জল জানান- মাদারগঞ্জ দুর্গম এলাকায় পাকবাহিনীদের প্রবেশ করা দুরহ ছিল। ফলে বিনোদটঙ্গী এবং শ্যামগঞ্জ কালিবাড়ি, পাটাদহ, কয়ড়া, পলিশা হাই স্কুলে মুক্তিবাহিনীদের অস্থায়ী ক্যাম্প করেন। এই ক্যাম্পগুলো থেকে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ পরিচালনা করা হতো। মুক্তিবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ বিনোদটঙ্গী ক্যাম্প উড়িয়ে দেবার জন্য পাকবাহিনীদের সব চেষ্টায় ব্যার্থ হয়। কারণ মেলান্দহ সিও’র অফিস থেকে বিনোদটঙ্গীতে যেতে মাদারদহ নদীর পয়লা ব্রিজ, ঝাড়কাটা নদীর উপশাখা মায়ানমার ব্রিজ এবং মাহমুদপুর বাজারের পূর্ব পাশের খাল পাড়ি দিতে হবে। মুক্তিবাহিনীরা আগে থেকেই এই সকল স্থানে ব্যুহ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আবার হাজরাবাড়ি হয়ে মাদারগঞ্জ যেতেও হাজরাবাড়ি এলাকায় মুক্তিবাহিনীদের অবস্থান ছিল। মুক্তিবাহিনীদের এই প্রতিরোধ পেরিয়ে দাঁতভাঙ্গা নদী, ঝাড়কাটা নদী এবং কালুমন্ডলের খাল পাড়ি দেয়া ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
তৎকালের মাদারগঞ্জ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রফিক উদ্দিন তালুকদার, শ্যামগঞ্জ কালিবাড়ির ডা. সৈয়দুজ্জামান, চরপাকেরদহের সুজাউদ্দৌলা চৌধুরী, গুনারীতলা মোসলেমাবাদের মোয়াজ্জেম হোসেন জলিলসহ আরো কিছু নেতৃস্থানীয়রা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।
মায়ানমার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারি মজনু মিলিটারি, আব্দুল কদ্দুস, আহসান হাবিব শাহজান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকায় নদী পারাপারকারি সিরাজ উদ্দিন মাস্টার জানান-মাহমুদপুর এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন আওয়ামী লীগ নেতা লেবু মিয়া, মেলান্দহ থেকে নেতৃত্ব দিতেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হাই বাচ্চু মিয়া, ডা. নূরুল ইসলাম, চরপাড়ার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, মালঞ্চর রুস্তম আলী কন্ট্রাক্টর, আব্দুল মজিদ চেয়ারম্যান, আঃ খালেক চেয়ারম্যান, ঘোষেরপাড়া থেকে আমিসহ আরো অনেকেই।
এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারিদের সাইদুর রহামন ও সালাহ উদ্দিন জানান-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। পাকসেনাদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিতে মাদারগঞ্জ এবং মাহমুদপুরের প্রবেশ পথের মাদারদহ নদীর উপর পয়লা ব্রিজ ধ্বংস করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কয়েকদিন পরেই পাকসেনারা নদী পাড়ি দিয়ে মাহমুদপুরের দিকে প্রবেশ করার খবর পেয়ে আগে থেকেই মাহমুদপুর-বিনোদটঙ্গীতে অবস্থান নেয়া বিভিন্ন স্থানের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে মায়ানমার নামক স্থানে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধে আলম কোম্পানির টুআইসি এবং মেলান্দহ হানাদার মুক্তকারি আব্দুল করিম জানান-পয়লাতে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীর এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে ১২ পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর কদ্দুসসহ ২ জন ধরা পড়েন। মুক্তিযোদ্ধা সমর এবং রমিজ উদ্দিন শহীদ হন। পাকসেনারা নির্যাতনের পর জামালপুর কালিঘাটে নিয়ে হত্যা করে। তাঁদের লাশও পাওয়া যায়নি। যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। মেলান্দহের ইতিহাসে এটিই ছিল বড় ধরণের যুদ্ধক্ষেত্র।
যুদ্ধকালে পাকবাহিনীরা সিও’ অফিসের পাশে বহু লোককে হত্যা শেষে মাটিতে পূঁতে রাখে। বর্তমানে এটি উপজেলা পরিষদ চত্বর। সেই বধ্যভূমিরও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। রেলওয়ে ব্রিজে পাকবাহিনীর ক্যাম্পেও বহু নারী-পুরুষদের হত্যার কথা লোকমুখে শোনা যায়। এমনকি শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদেরও নেই কোন স্মৃতিফলক। স্থানীয় একজন গণমাধ্যমকর্মীর (শাহ্ জামালের) লেখনিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য মির্জা আজমের নির্দেশে কতিপয় শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ব্রিজ ও রাস্তার নামকরণকে স্বাগত জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি সংরক্ষণ না থাকার প্রশ্ন মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষেরও। মাহমুদপুর ইউপি চেয়ারম্যান, মেলান্দহ আ’লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই দাবির সাথে একমত পোষণ করে বলেন-মেলান্দহে একমাত্র মাহমুদপুরেই বড় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা-পাকসেনাসহ সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে। তিনি এখানকার যুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধকে ঐতিহাসিকভাবে স্মরণী করতে একটা কিছু করার দাবি করেন।
সম্প্রতি বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরামের মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার রাশেদুল হাসান শেলী এবং যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল লতিফ রেজা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে মেলান্দহের পয়লাসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্পট পরিদর্শণ করেন। এ সময় তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক সেলিম মিঞার কাছে স্মৃতি সংরক্ষণের যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করেন।
এ ব্যাপারে ইউএনও সেলিম মিঞা জানান-মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের যৌক্তিক দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সম্মুখ যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছি। স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রাথমিকভাবে একটা স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাস্তবতা উপলব্ধি করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি দ্রæত একটা রেজাল্ট পাব।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।