সেবা ডেস্ক : পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতায় সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সমাজের দর্পণ, মানুষের অধিকার, অবহেলিত লাঞ্চিত ও সর্বক্ষেত্রে কলমের কালিতে ফুটে উঠা প্রতিবাদী কণ্ঠ।
সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ইত্যাদি বহু বিশেষণে তাকে ভূষিত করা হয়। সংবাদ বলতে মুদ্রণজগৎ, প্রচার মাধ্যম, সম্প্রচার কেন্দ্র, ইন্টারনেট কিংবা গণমাধ্যমের উপস্থাপিত বর্তমান ঘটনা প্রবাহের একগুচ্ছ নির্বাচিত তথ্যের সমষ্টি, যা যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সকলের নিকট প্রকাশিত হয়।
আর ইসলামী সংবাদ হলো, মানবিক ও মনের কুপ্রবৃত্তির মনোভাবে বশীভূত না হয়ে মানব কল্যাণে সত্য সংবাদ সকলের উপস্থাপন করা । তবে গতানুগতিক সাংবাদিকতার পরিবর্তে শাশ্বত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে এর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধিনিষেধ রয়েছে। আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা ইসলামের অন্যতম ইবাদত। আর সাংবাদিকতা কিছুতেই দাওয়াত বিযুক্ত নয় ।
কেননা ইসলামে সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি তিনটি বিষয়ের ওপর-
১। আল্লাহর পথে আহ্বান।
২। সৎ, সত্য ও ন্যায়ের আদেশ করা।
৩। অসৎ, অসত্য ও অন্যায় থেকে বাধা প্রদান। তবে প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইসলামে সাংবাদিকতার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য ও নীতিমালা রয়েছে।সাংবাদিকতা একটি পবিত্র আমানতএ আমানত হচ্ছে, যেকোনো তথ্য ও সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মত বা ব্যক্তির স্বার্থের জন্য সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে সংবাদ পরিবেশন করাকে কিছুতেই ইসলাম সমর্থন করে না।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন ছাড়াই সংবাদ পরিবেশন করা এবং সংবাদের অঙ্গসজ্জায় কেবল মাত্র সত্যকেই তুলে ধরা। এ বিষয়ে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৭০নং আয়াতে এরশাদ করেন, হে ইমানদারগণ! আল্লহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো ।সংবাদের সত্যতা সম্পর্কে কঠোর ভাবে সতর্ক করে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লহর রাসুল! হ্যাঁ, অবশ্যই।
তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া। এরপর হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসুল (সা.) বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা- (বোখারি)। তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য।মিথ্যা সংবাদ উপস্থাপন করা কবিরা গুনাহ, কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শিখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। কোন সংবাদ পাওয়ার পর অবশ্যই তা ভাল করে যাচাই বাচাই সম্পন্ন করে তারপর সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে।
সংবাদের বিশ্লেষণ তথা সত্যতা যাচাই বাচাই করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা হুজরাতের ৬ নং আয়াতে এরশাদ করেন – “হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়”। মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করাই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে সহীহ মুসিল শরীফে মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, যা শুনবে, তা-ই (যাচাই করা ছাড়া) বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সংবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে অর্থাৎ পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়ার পর তা গোপন না করতে ইসলামের আদেশ রয়েছে। এবং তথ্য গোপন করাকে পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূরা বাকারার ২৮৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে “তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী”। এজন্য প্রত্যেক সংবাদ উপস্থাপন কারী অর্থাৎ একজন সাংবাদিক বা গণমাধ্যম কর্মীকে অবশ্যই সতর্ক হয়ে ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, অর্থলোভ ইত্যাদি বর্জন করে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে।
সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন; যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়- (তিরমিজি শরিফ) কোন স্বার্থে প্রভাবিত হয়ে কারো চরিত্রে কলমের ধারালো অশ্র দিয়ে আঘাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে হেয় করা যাবে না।
কারো একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত কাজ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৮ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ” কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে” ।বোখারি ও মুসলিম বলা হয়েছে , যে ব্যক্তি নিজ ভাইয়ের দোষ-ক্রটি গোপন রাখে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।
তবে ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি যদি এমন পর্যায়ে চলে যায় অর্থাৎ তার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার অত্যাচার, দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে তার আসল চেহারা তুলে ধরা অবশ্যই কর্তব্য ।
সূরা নিসার ১৪৯ নং আয়াতে যে কথা বলা হয়েছে, “আল্লাহ মন্দ কথার প্রচার-প্রসার পছন্দ করেন না, কিন্তু যার ওপর জুলুম করা হয়েছে (তার কথা ভিন্ন) “।এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নির্যাতিত নিপীড়িত জনতার সপক্ষে গিয়ে জালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা এবং বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করা। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধর্ম, বর্ণ জাতি সংবাদ প্রচারে বাধা হতে পারে না।
সংবাদ ও সাংবাদিকতা ইসলামের দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর তা কিছুতেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। সূরা আরাফের ১৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি বলো, হে মানব সমাজ, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহর রাসুল । সূরা ফোরকানের ১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফোরকান (কোরআন) অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে ।কাজেই সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র-শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়েই সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ নেই ।
সত্য প্রকাশে আপোষ করা যাবে না – কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ। অন্য এক হাদিসে হজরত মুয়াজ (রা.) বললেন, রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো, যদিও তা তিক্ত হয়। মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পক্ষপাতিত্ব সংবাদ বর্জন করতে হবে পক্ষপাতীত্ব সংবাদ পরিবেশন করা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয় কাজ। কেননা এই সংবাদ পরিবেশন করলে অন্যায়কারীর সাহস আরো বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা হুঁশিয়ারি দিয়ে সূরা হুদ এর ১১৩ নং আয়াতে বলেন , “যারা সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে। সূরা মায়েদার ৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তাই পক্ষপাতিত্ব সংবাদ অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।
গণমাধ্যমের ভাষাকে কেবল লালনই করে না; বহু নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টিও করে। ভাষাকে সহজ, সাবলীল ও সমৃদ্ধ করে সকলের নিকট উপস্থাপন করা গণমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্ব। তাই নানা প্রেক্ষাপটে, পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতার কথা বিবেচনা করে সদুপদেশের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথে আহ্বান করা নৈতিক দায়িত্ব ।
সূরা নাহলের ১২৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, তুমি মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে”। সংবাদ ও সাংবাদিকতায় স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়নতা, সাবলীল ভাষা ব্যবহার, সকল লোভ ত্যাগ করে সকলের নিকট সত্য প্রকাশ করা সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব।
মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী
গবেষক, কলামিস্ট, গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মী।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।