নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়েও সেবায় পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্যকর্মীরা

S M Ashraful Azom
0
নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়েও সেবায় পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্যকর্মীরা

সেবা ডেস্ক: পূর্ণাঙ্গ পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাকে শরীরকে ঢাকায় কারোরই চেহারা চেনার কোন সুযোগ নেই। এমনকি কে পুরুষ, কে নারী তা-ও মাঝেমধ্যে বোঝা অসম্ভব হয়ে পরে। আবার সবার আবরণ একই সাদা রঙের হওয়ায় কিংবা আলাদা কোনো চিহ্ন না থাকায় তাঁদের কে কোন অবস্থানে চাকরি করেন তা-ও ঠিকমতো নিরূপণ করা কঠিন। তবে তাঁদের কেউ এসে যখন পরম মমতায় ছোট্ট পালস অক্সিমিটার যন্ত্রটি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর আঙুলের ডগায় বসিয়ে দেন কিংবা কেউ হাতের বাহুতে সযত্নে রক্তচাপ মাপার বেল্ট পরিয়ে দেন আলতো করে, তখন মনের অজান্তেই খুব আপন হয়ে ওঠেন তাঁরা। কেউ বা শরীরের উপলব্ধি খোঁজ নিতে নিতে বলেন, আমি ডা. লতিফুল মুবিন, কেউ বা বলেন আমি ডা. তৌহিদ, ডা. চৈতি, ডা. শারমিন কিংবা ডা. দীপঙ্কর। পাশ থেকে আরেকজন হয়তো রোগীর ডায়াবেটিস মাপতে মাপতে বলেন, আমি নার্স ইসরাত বা অন্য কোনো নাম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত এই মানুষগুলোর কারো মধ্যেই এখন আর ন্যূনতম ভয় কিংবা জড়তার লেশমাত্র নেই। অথচ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসক ও নার্সদের খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগ ছিল প্রায় নিত্যদিনের। ভয়ে চিকিৎসক ও নার্সরা রীতিমতো পালিয়ে থাকতেন বলে বলতে শোনা গেছে অনেক রোগীকে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে এই হাসপাতালটিতে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। এখন বরং কেউ রোগীর সেবা দিতে দিতে নিজেই আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন এই হাসপাতলে, তবু তাঁর জায়গায় ঠিকই ছুটে আসছেন আর একজন। এমনকি নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েই তরুণ চিকিৎসক ও নার্সরা যোগ দিয়েছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায়। শুধু কি তাই, অন্য কর্মীরা যেমন ট্রলি ঠেলেন, চিকিৎসকরা নিজেরাও রোগীর ফাইল ও যন্ত্রপাতির ট্রলি নিজেরাই ঠেলে নিয়ে যান এক রোগী থেকে আরেক রোগী, এক রুম থেকে আরেক রুমে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. লতিফুল মুবিন বলেন, ‘এই হাসপাতালে প্রতিদিন যেমন সাধারণ রোগীরা আসেন, ভর্তি হন, একইভাবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো চিকিৎসক ও নার্স ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা এই হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছেন। আশার কথা হলো, আমরা এখন আর ভয় পান না, বরং আমরা ধরে নিয়েছি এটাই আমাদের দায়িত্ব। আক্রান্ত যে কেউ যেকোনো সময় হতেই পারি, ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। বরং রোগীর সেবা করে যদি আক্রান্ত হয়েও পড়ি সেটাও এক ধরনের প্রশান্তি। আমরা নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের এখন সেভাবেই মোটিভেশন দিচ্ছি। ফলে কেউ আর ভয় পায় না; আমাদের ভয় কেটে গেছে।’

কেবল কি চিকিৎসক-নার্স! এই যে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমেনা বা সুলতানারার মতো একের পর এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে করোনা আক্রান্ত রোগীদের রুম পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছেন, দিনে চারবার সুমন কিংবা তাঁর মতো কেউ এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে কেউ এসে কাউন্সেলিং করছেন কিংবা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন—তাঁদের কারো মাঝেও ভয়ের কোনো চিহ্নের দেখা মেলে না এখন আর!

হাসপাতালের বিশেষভাবে সংরক্ষিত ওয়ার্ড বা কেবিন ব্লকের রেড জোনগুলোতে রোগী ছাড়া সব সেবাকর্মীই পিপিই ব্যবহার করেন। কিন্তু এর বাইরে সবুজ জোনে বসে পিপিই ছাড়াই সারাক্ষণ চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের ফাইলপত্র নিয়ে পর্যালোচনা-পরিকল্পনা করতে থাকেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। কোন রোগীর কী সমস্যা, কার কখন কী সমাধান দিতে হবে—সব কিছুই চলে নিখুঁতভাবে। কখনো না কখনো চলতে থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার টানাটানি কিংবা সিলিন্ডার পরিবর্তনের কাজ। একটি সিলিন্ডার খালি হলে আরেকটি পূর্ণ সিলিন্ডার দ্রুত ম্যানেজ করে তা ঠেলে দেন পলিথিনের ব্যারিকেড দেওয়া রেড জোনের ভেতরে। টুংটাং শব্দ করে চলতে থাকে কোনো না কোনো সিলিন্ডার মেরামতের কাজ। অনেক সময় পিপিই ছাড়াই কোনো চিকিৎসক বা নার্স জরুরি প্রয়োজনে রোগীর মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এর পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের কিংবা তাঁদের সঙ্গে থাকা নিজস্ব সেবাকর্মীকে শিখিয়ে দেন জরুরি প্রয়োজনে কিভাবে অক্সিজেন প্রয়োগ করতে হবে, কিভাবে পালস অক্সিমিটার ব্যবহার করতে হবে। যখন রোগীর প্রয়োজন হয় হাতে স্লিপ ধরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এক্স-রে করতে। অল্প সময়ের মধ্যেই এক্স-রে করে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় ফিল্ম। এর বাইরে ওষুধ থেকে শুরু করে সব কিছুই সরবরাহ করা হয় হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে। আর শয্যা ভাড়া পুরোটাই ফ্রি।

গতকাল প্রায় সাড়ে ৩০০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিল বলে জানিয়েছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমদ। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে চিকিৎসক-নার্স ক্লিনারসহ সব কর্মীর মনবল শক্ত করে, ভয়কে জয় করে রোগীর সেবা করার মানসিকতা তৈরিতে সাহস জোগাতে সক্ষম হয়েছি।’

ভিডিও নিউজ


-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top