সেবা ডেস্ক: বাস্তবিক অর্থে ছয় দফা আন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়, হয় ছয় দফার পক্ষে, না হয় বিপক্ষে। ধান্দাবাজ, সুবিধাবাদী তথাকথিত প্রগতিবাদীদের পক্ষে ছয় দফার পক্ষে থাকা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে এই বিভাজন প্রকট ধারণ করে। ন্যাপ নেতা মশিয়ুর রহমান ছয় দফাকে বিচিন্নতাবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, এর জবাবে বঙ্গবন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন:
“জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজেদের চীনপন্থী বলেও থাকেন। একজন একদেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়?”
হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের পাশাপাশি গর্ভনর মোনায়েম খান গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও হরণ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম।”
৭ জুন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজেরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কম ছিল না, একই সঙ্গে এদেশের জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল সীমাহীন। সারা জীবন ত্যাগ আর আদর্শের রাজনীতি করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।’
৭ জুন বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাধে উজ্জ্বল একটি দিন। আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আপামর জনতা রাজপথে নেমে আসে। নজিরবিহীন হরতাল পালন করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৭ জুন দিনলিপির পাতায় লিখেছেন:
“সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আব্দুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিক্সা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকতে দেওয়া হয়নি। অশান্তি সৃষ্টি করেছে, যাদের শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ছিল। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টিয়ার গ্যাস, লাঠি চার্জ করে ক্ষান্ত হয়নি; গুলি করে সরকারি হিসেবে ১০ জনকে হত্যা করেছে। গ্রেপ্তার করেছে অগণিত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।… অনেক রাত হয়ে গেল, ঘুম তো আসে না। নানা চিন্তা এসে পড়ে। এ এক মহাবিপদ, বই পড়ি, কাগজ উল্টাই, কিন্তু তাতে মন বসে না।”
একজন মহান নেতা দেশ ও জনগণের কথা না ভেবে পারেন না। ছয় দফা দমনের নামে সরকার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। ১৩ জুন তারিখের মধ্যে ৯,৩৩০ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে বন্দি করা হয়। এর পূর্বে আওয়ামী লীগের প্রায় ৩,৫০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করা হয় ১০ মের মধ্যে। সরকারি চরমপন্থার অংশ হিসেবে ১৫ জুন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের দিন ১৬ জুন। ইত্তেফাক নিষিদ্ধ এবং পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করে সরকার। বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামে মানিক মিয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সম্পর্ক। দুজনেই ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“মানিক ভাইকে সেখানে রেখেছে, সেখান থেকে খবর আনা খুবই কষ্টকর। এত বড় আঘাত পেলাম তা কল্পনা করতে বোধ হয় অনেকেই পারবে না। প্রথম থেকেই এই কাগজের (ইত্তেফাক) সাথে আমি জড়িত ছিলাম।”
জুলম-নির্যাতনের পাশাপাশি ছয় দফার আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। সর্বোপরি আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কোন্দল ও ভাঙনের ষড়যন্ত্র করে সরকার। নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যে দলের ঐক্য ধরে রাখা এবং ছয় দফার আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই রকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (Pakistan Democratic Movement বা পিডিএম) গঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন যে, ছয় দফার আন্দোলন নসাৎ করার জন্যই এসব আয়োজন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে লিখেছেন:
“৬ দফার জন্য জেলে এসেছি, বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে আমি পারব না।”
শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও কারাগারের ফটক থেকেই সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসের ১০ নং কক্ষে তাঁকে বন্দি করা হয়। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলার এক নম্বর আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এমনকি বন্দি অবস্থায় তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়। দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাধ্য হয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দেন। যদিও মামলা চলাকালীন ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানন্দিতে বঙ্গবন্ধু নিজেকে নির্দোষদাবী করে বলেন:
“আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি।… আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই।… আমি কখনো পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য কোনো কিছু করি নাই কিংবা কোনোদিনও এই উদ্দেশ্যে কোনো স্থল, নৌ বা বিমানবাহিনীর কোনো কর্মচারীর সংস্পর্শে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই।”
যৌক্তিক কারণেই বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য সব অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা এবং স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে যে, মূলত কৌশলগত কারণে তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কর্ণেল শওকত আলী তাঁর ‘সত্য মামলা আগারতলা’ গ্রন্থে লিখেছেন: “অভিযুক্তদের সঙ্গে বসে অভিযোগনামা শুনতে শুনতে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমাদের সার্বিক পরিকল্পনার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনায় তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন।”
বলা যেতে পারে এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার জন্য তিনি কোনো পন্থাই বাদ দেননি। বাবা-মা, পুত্র-কন্যার ভালবাসা বিসর্জন দিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। দেশের মানুষও তাঁকে ভালবেসেছে অকৃপণভাবে। ছাত্র-জনতা তাকে আইয়ুব কারাগার থেকে মুক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।