সেবা ডেস্ক: বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে জমায়েত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছুটি দেয়া হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালত। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যানবাহন চলাচল। বাজার, মার্কেট ও শপিংমলগুলোও এখন ফাঁকা।
এরইমধ্যে মসজিদে নামাজের মুসল্লি সংখ্যা নিয়ে ধর্ম মন্ত্রাণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সাধারণ নামাজে সর্বোচ্চ পাঁচজন আর জুমাতে দশজন অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে জানার আগ্রহ দেখা দিয়েছে যে, এভাবে জুমা আদায় করলে জুমা হবে কি? যারা জুমায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তারা বাড়িতে জুমা পড়বে নাকি জোহরের নামাজ আদায় করবে? জোহর একা পড়বে নাকি জামাতে?
উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে গত ৩ শাবান, মোতাবেক ২৯ মার্চ এ প্রসঙ্গে একটি ফতোয়া প্রকাশ হয়েছে। এতে এ প্রশ্নগুলোর সমাধান দেয়া হয়েছে। ডেইলি বাংলাদেশ পত্রিকার পাঠকদের জন্য এর অনুবাদ তুলে ধরা হয়েছে।
ফতোয়া জিজ্ঞাসা করেছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মোহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নুমানী হাফিজাহুল্লাহ। উত্তর দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানেরই ফতোয়া বিভাগের মুফতিরা।
প্রশ্ন: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে, জুমা নিয়ে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সেখানে পরামর্শ ছিল জুমার নামাজ আদায় করা হবে সীমিত আকারে। যেমন মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও আরো দু’তিনজন মুসল্লি নিয়ে। এলাকার বাকি মুসল্লিদের প্রতি পরামর্শ ছিল, তারা যেন মসজিদে না আসেন বরং নিজেদের মহল্লায় কারো বৈঠকখানা, বাহির কামরা ইত্যাদিতে ‘ইজনে আ’ম’ থাকার শর্তে জুমা পড়ে নেয়। অর্থাৎ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনরূপ চাপ না থাকলে বাকিরা এভাবে জুমা আদায় করবে। (‘ইজনে আ’ম’ একটি ফিকহি পরিভাষা। জুমা সহিহ হওয়ার জন্য ‘ইজনে আ’ম’ থাকা শর্ত। ‘ইজনে আ’ম’ বলা হয়, যাদের ওপর জুমা ফরজ, বিনা বাধায় তাদের নামাজে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা)।
যাদের কোনো কারণে জুমা পড়ার সুযোগ হবে না, তাদের প্রতি পরামর্শ ছিল তারা একাকি নিজেদের ঘরে জোহর আদায় করে নেবে। দারুল উলুমের মুফতি হজরত মাহমুদ হাসান বুলন্দশহরী ও হজরত জয়নুল ইসলাম (হাফি.) এক অডিও বার্তায় মানুষকে এই মাসালাই দিয়েছিলেন। আমি নিজেও এ ব্যাপারে একটি অডিও বার্তা দিয়েছিলাম। সেখানে ওই মুফতিদের হাওয়ালা দিয়ে মাসালা বলি।
এই পরামর্শ দেয়ার পর দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতিরা এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে পরস্পর পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন। তাদের এ বৈঠক এবং সেখানে পূর্বের পরামর্শটিই বহাল রাখার বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। তারপর জুমার দিন আসে। তখন কোনো কোনো আলেম ও মুফতির পরামর্শ ও মতামত এর বিপরীত আসতে থাকে। এজন্য দারুল উলুমের মুফতিগনের বর্ণিত মাসালার ভিত্তিতে ‘জুমার নামাজ সংক্রান্ত জরুরি ওজাহাত’ শিরোনামে একটি নির্দেশনা জারি করি। যেহেতু জুমার সময় কাছাকাছি ছিল, তাই নির্দেশনা জারির আগে মুফতিদের সঙ্গে পরামর্শ করা সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ আলেম ওই নির্দেশনার ওপর আস্থা প্রকাশ করেন। পূর্বের কোনো সিদ্ধান্তই যেহেতু আনুষ্ঠানিক ফতোয়া ছিল না, তাই নিম্নের বিষয়গুলোতে লিখিত আকারে ফতোয়া দিয়ে আমাদেরকে কৃতজ্ঞ করবেন। যেন ভবিষ্যতে মানুষকে সে অনুযায়ী আমল করার জন্য নির্দেশনা দিতে পারি।
জানার বিষয় হলো-
(১) দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মসজিদ ও অন্যান্য স্থানে জুমার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী?
(২) যাদের জুমা আদায়ের সুযোগ হবে না, জোহর তারা একাকি পড়বে, নাকি জামাতে?
নিবেদক, আবুল কাসেম নুমানী (মোহতামিম দারুল উলুম দেওবন্দ, তারিখ: ২৯.০৩.২০২০)।
উত্তর :
(১) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশে যে কোয়ারেন্টাইন চলছে, তাতে মসজিদ বা ঘরে জুমা আদায়ের বিস্তারিত বিবরণ হলো এই-
(ক) যে সব মসজিদে জুমা আদায় সহিহ হওয়ার শর্ত সমূহ পাওয়া যাওয়ার কারণে এতদিন ধরে জুমার জামাত হয়ে আসছে, যেমন শহর, উপশহর বা বড় গ্রামের মসজিদ, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সে সব মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে হবে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে কজন মুসল্লি নিয়ে জুমা আদায়ের অনুমতি দেয়া হবে, সে কজন নিয়েই জুমা আদায় করতে হবে। সেক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, ইমাম ব্যতিত সর্বনিম্ন তিনজন মুসল্লি থাকতে হবে। পূর্বে যে সব শহর বা উপশহরে কিছু মসজিদে জুমা হতো, বাকি মসজিদগুলো ছিলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের জন্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে সেখানের সব মসজিদে এখন জুমার জামাত চালু করা যেতে পারে; মুসল্লির সংখ্যা হবে চার থেকে পাঁচজন। এতেও কিছু মানুষের জুমা আদায়ের ব্যবস্থা হবে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে মসজিদে পাঁচ, ছয় জনের বেশি আসা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এটা জনগণের কল্যাণের জন্যই। তাই এটা জুমা সহিহ হওয়ার শর্ত ‘ইজনে আ’ম’ বা ব্যাপক অনুমতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা এ সব আইন দ্বারা মানুষকে জুমা থেকে ফিরিয়ে রাখা উদ্দেশ্য নয় বরং এগুলো লংঘন করা দ্বারা, যে বড় বিপদ আসতে পারে সেগুলো থেকে মানুষকে বাঁচানো উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে ফিকহের কিতাবগুলোতেও আলোচনা পাওয়া যায়। যেমন বলা হয়েছে, ‘জুমার নামাজে দাঁড়ানোর পর মসজিদে শত্রু প্রবেশের আশঙ্কা হলে মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেয়া ওয়াজিব।’ (হাশিয়াতুত ত্বহত্ববী আলাদ দুররুল মুখতার, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৪৪, প্রকাশক- মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ দেওবন্দ)।
প্রসিদ্ধ একটি ফতোয়ার কিতাব ‘ইমদাদুল ফতোয়া’। সেখানে এ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘ ‘ইজনে আ’ম’ থাকা জুমা সহিহ হওয়ার শর্ত। এর মর্ম হচ্ছে, কোনো ব্যক্তিকে নামাজের কারণে ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। অন্য কোনো কারণে ফিরিয়ে দেয়া হলে, তা ‘ইজনে আ’ম’ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।’ (ইমদাদুল ফতোয়া, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬১৪, প্রকাশক- মাকতাবায়ে জাকারিয়া দেওবন্দ)।
ইমদাদুল আহকামে এসেছে, ‘যদি সেনানিবাস বা দূর্গের ভেতরে জুমা আদায় করা হয় তাহলে জুমা সহিহ হবে। যদিও সেনানিবাস বা দূর্গের ভেতরে বাহির থেকে লোক আসা নিষেধ। কেননা, নিষেধের কারণ নামাজ থেকে ফিরানো নয় বরং শৃঙ্খলাগত। (ইমদাদুল আহকাম, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৭৫১, প্রকাশক-মাকতাবায়ে দারুল উলুম করাচি)। (আলোচনার সারমর্ম হলো নামাজের কারণে কাউকে আসতে বাধা দিলে সেটা ‘ইজনে আ’ম’ এর সাংঘর্ষিক হবে। শৃঙ্খলা, জনস্বার্থ বা নিরাপত্তার জন্য বাধা দিলে সাংঘর্ষিক হবে না)।
(খ) মহল্লার যারা মসজিদে জুমা আদায় করতে পারবে না, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো হয়রানি বা নিষেধের আশঙ্কা না হলে ‘ইজনে আ’ম’ এর সঙ্গে নিজেদের বৈঠকখানা বা বাহির কামরায় জুমা আদায় করবে। অর্থাৎ আশপাশের লোকদেরকে ইত্তেলা দিবে, যেন যাদের জুমায় শরীক হওয়ার ইচ্ছা আছে তারা শরীক হতে পারে। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার খাতিরে এখানেও যদি চার-পাঁচজনের বেশি জমায়েত হওয়া নিষেধ হয় তাহলে ইমাম ব্যতিত তিনজন বালেগ পুরুষ মুসল্লি নিয়ে জুমাই আদায় করবে। খুতবা ও কেরাত সংক্ষেপ করবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো হয়রানি বা বিধি-নিষেধের আশঙ্কা হলে জুমার আগেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে আশ্বস্ত করবেন। সতর্কতা স্বরূপ নিম্নের দু’টি বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে-
এক. যারা নিজের ঘর বা বাইরের কামরায় তিন, চারজন মুসল্লি নিয়ে জুমা আদায় করবেন, আশঙ্কা ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলোতে তারা শুধু নিজেদের বুঝের ওপর ভরসা করবেন না। বরং দুজন আলেম ও অবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে জানেন এমন দু’জন ব্যক্তির পরামর্শ নিয়ে জুমা আদায় করবেন।
দুই. ভবিষ্যতে অবস্থা কোন দিকে গড়াবে তা এখন বলা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেক শুক্রবারে জুমা আদায়ের ব্যাপারে ওই দিনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অবস্থা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পূর্বের কোনো জুমার ওপর তুলনা করে জুমা কায়েম করা যাবে না।
(গ) শহর, উপশহর বা বড় গ্রামে থেকেও যারা পূর্বে বর্ণিত বিবরণ মেনে নিজেদের বৈঠকখানা বা বাহির কামরায় জুমা আদায় করতে সক্ষম হননি। চাই তা জুমার ইমাম না পাওয়া, প্রশাসনের পক্ষ থেকে হয়রানির আশঙ্কা, মানুষের সৃষ্টিগত ভয়, তিনজন মুসল্লি না পাওয়া বা অন্য কোনো কারণে হোক তারা শরীয়তের দৃষ্টিতে অপারগ হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। তারা জুমার স্থলে জোহর আদায় করে নেবে। এটা তাদের জন্য মাকরূহও হবে না। কেননা, নিজেকে হয়রানিতে ফেলা ইসলাম সমর্থন করে না।
(২) দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো যারা জোহর আদায় করবে তারা একাকি পড়বে নাকি জামাতের সঙ্গে?
এর উত্তর হলো, তারা জোহরের নামাজ একাকি পড়বে, জামাতে নয়। কারণ, শরীয়তের বিধান হলো, যে সব এলাকায় জুমা সহিহ হওয়ার শর্ত পাওয়ার কারণে জুমা আদায় করা হয়, সেখানকার অপারগ বা স্বাভাবিক ব্যক্তিদের জন্য জোহরের নামাজ জামাতে আদায় করা মাকরূহ। চাই জুমা ছোট জামাতে আদায় হোক বা বড়, এক জায়গায় হোক বা বহু জায়গায়। হানাফি ফিকহের মৌলিক কিতাবাদি ও আকাবিরে দেওবন্দের ফতোয়াতে এমনটাই পাওয়া যায়। দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে এই মতই গ্রহণযোগ্য। কেউ কেউ জোহরের নামাজ জামাতে পড়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ আলেম ও মুফতি এ মতের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।
জুমা সহিহ হওয়ার শর্ত যে সব গ্রামে পাওয়া যায় না। সেখানে পূর্ব থেকে জুমার দিনে জোহরের জামাত হয়ে আসছে। এখনও সেখানের লোকেরা মসজিদ বা ঘরে জোহরের নামাজ জামাতে আদায় করবে। একাকি পড়ার প্রয়োজন নেই। (যে গ্রামে জুমা সহিহ হয় না, বিজ্ঞ আলেমদেরর মতে বাংলাদেশে এমন গ্রাম নেই)।
প্রশ্নের উভয় অংশের উত্তরে হানাফি ফিকহের মৌলিক কিতাবাদি, আকাবিরে দেওবন্দের ফতোয়া ও মতানৈক্যের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে। তবে সংক্ষেপের কারণে সব দলীল উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। - সব বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।