ছবিতে: শ্রীবরদী উপজেলার সিংগাবরনা ইউনিয়নের বাবেলাকোনা গ্রামের আদিবাসী নারী কৃষাণী পিরিলা সাংমা |
রেজাউল করিম বকুল, শেরপুর প্রতিনিধি: “মেলা দিন অইলো, এক বেলাও ঠিক মতো খাইতে পাইনা। সরহারের লোক আহে, মেম্বাররা আহে, খালি হাত ধোবার কয়, খাবার দেয় না। কেমনে বাচুঁম। পোলাপানগরেই ক্যামনে বাঁচামু। মানষের কাছে ধার লইয়া বুরো ধান লাগাইছি। এডাও হাতি আইয়া খাইয়া ফাইলাইতাছে। কেউ আমগোরে খবর নেয় না। অহন আমগোর মরার ওপর খড়ার ঘা।” কথাগুলো বলছেন শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিংগাবরনা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের বাবেলাকোনা গ্রামের লেটারসন মারাকের স্ত্রী পিরলা সাংমা (৪৫)। তিনি জানান, এক দিকে বন্যহাতি অন্যদিকে করোনার ভয়। এতে উভয় সংকটে পড়ে টিকে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একি গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া, নুরতাজুল হক, দুলাল মিয়া ও পার্শ্ববর্তী চান্দাপাড়া গ্রামের আমজাদ হোসেন, ফুলু মিয়া, গোলাপ মিয়াসহ অনেকে জানান, দিনে করোনার ভয়ে তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। রাতে চলে বন্যহাতির হামলা।
এতে তাদের আধা পাকা বুরো ধান ক্ষেত খেয়ে ফেলছে। নষ্ট করছে শাকসবজির ক্ষেতও। গত চার পাঁচ দিনে সবজি ক্ষেত সহ বুরো ধানের কমপক্ষে ২০ একর জমির ফসল নষ্ট করেছে। ফলে চরম সংকটে পড়েছেন সীমান্ত এলাকার বাবেলাকোনা, হারিয়াকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘাদল, বকুলতলা, মালাকোচা, খ্রিষ্টানপাড়া, খারামোরা ও বালিজুরিসহ প্রায় ২০টি গ্রামের ১০ সহা¯্রাধিক লোক। মঙ্গলবার সরেজমিন গেলে গ্রামবাসী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজনের সাথে কথা বলে ওঠে আসে এমন তথ্য।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, করোনায় ঘরে থাকা কর্মহীন ও অসহায় লোকদের জন্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও চলছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা প্রচার কার্যক্রম। চলছে বাজার মনিটরিং। এমনকি অভুক্ত পরিবারদের জন্যে দেয়া হয়েছে একটি হট লাইন মোবাইল নাম্বার। এখন করোনার প্রভাব ঠেকাতে প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনী সার্বক্ষণিক ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে গ্রামাঞ্চলের অনেক অভুক্ত লোক জানেনা তাদের হটলাইন মোবাইল নাম্বার। দু’একজন যদিও নাম্বার পেয়েছেন। তারা কল দিয়েও কোনা সাড়া পাচ্ছেনা বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সীমান্তবর্তী আদিবাসী এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা ভূপেন্দ্র মান্দা বলেন, এখানের বেশিরভাগ লোকজন খেটে খাওয়া। দিন আনে দিন খায়। করোনার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন। মেম্বার চেয়ারম্যানরা ঠিকমতো ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছেন না। ফলে অনেক মানুষ এখন ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সিংগাবরনা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রেজ্জাক মজনু মিয়া বলেন, অভাবি মানুষ বেশি। ত্রানের পরিমান একেবারেই কম। এ জন্য অনেকেই বাদ পড়ছেন। কয়েকদিন থেকে প্রতিরাতে বন্যহাতির উপদ্রবে বুরো ক্ষেত ধান নষ্ট হচ্ছে বলে সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, হাতির অত্যাচারে রাতে কেউ ঘুমাতে পারে না।
রাত জেগে তারা ধান ক্ষেত পাহারা দিচ্ছেন। এ বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, উপজেলা দুই জনের করোনা সংক্রমনের রোগী পাওয়া গেছে। তাদেরকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়াও অনেকের নমুনা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে বলা যাবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার কালের কন্ঠকে বলেন, প্রত্যেক দিন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা মনিটরিং করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পৌর শহরসহ প্রত্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে।
বন্যহাতির ব্যাপারে তিনি বলেন, বন্যহাতি কয়েক জনের ক্ষেত নষ্ট করেছে। তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে উপজেলার খনচেপাড়া, চিতলিপাড়া মোড়, গড়খোলা, কাকিলাকুড়া চৌরাস্তা, কর্ণঝোড়া, ভায়াডাঙ্গা, বালিজুরি ও রানীশিমুলসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে চা ও মুদি দোকানগুলোর সামনে মানুষের ভিড়। তাদেরকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা বললেও অনেকে বুঝতে অক্ষম। কেউবা মানতে নারাজ।
এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়াসহ বন্যহাতির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ি এলাকার লোকজনদের মাঝে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা জোড়দারের দাবি জানান ভুক্তভোগি ও সচেতন মানুষরা।