সাড়ে তিন হাজার ঘর পুড়ে ছাই

S M Ashraful Azom
0
Three and a half thousand houses burned down
সেবা ডেস্ক: সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফেরেন মুজিবর রহমান (৫৫)। প্রতিদিনের মতো রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত তাঁর স্ত্রী সাবিনা খাতুন।

বস্তির অন্য ঘরগুলোতেও সবাই খাওয়াদাওয়া, আড্ডায় মশগুল। হঠাৎ বস্তির দক্ষিণ পাশের একটি ঘরে আগুন লাগলে ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার শুনে সবাই প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে এলেও ঘরের মালামাল কেউ সরাতে পারেনি। মুজিবরও পারেননি। মুহূর্তেই পুড়ে ছাই ৩০ বছরের পুরনো নিজের বসবাসের একমাত্র ঘরখানা। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে নেভাতে রাত ১২টার মধ্যে বস্তির ৯৫ শতাংশ পুড়ে ছাই। মুজিবর রহমানের মতো বস্তির প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরের ৫০ হাজারেরও বেশি বস্তিবাসীর ঠাঁই এখন রাস্তায়।

আঁখি আক্তার নামে বস্তির এক বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বাসাবাড়িতে কাম কইরা খাই। রাইতে আইসা এইহানে একটু মাথা রাখার জায়গা আছিলো। এহন রাস্তায় থাওন ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনে রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকার মোড়ে ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে বস্তির দক্ষিণ পাশের কাঠের তিনতলা একটি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করলেও ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ায় আরো ১৭টি ইউনিট যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের প্রায় দেড় শ কর্মী, পুলিশ, র‌্যাব ও স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় রাত ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বাঁশ ও টিনের তৈরি ঘরের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বাতাসের তীব্রতায় সেটা আরো বেড়ে যায়। আগুনের এই ঘটনায় চারজন আহত হলেও রাত সাড়ে ১২টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো নিহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের অস্থায়ী তথ্যকেন্দ্র থেকে আহত দুজনের নাম জানা যায়। এঁরা হলেন কবীর (৩৫) ও হাবীব (১১)। এলাকাবাসী জানায়, আহত অন্য দুজন হলেন রফিক (৫০) ও হাসিনা বেগম। 

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, আগুন লাগার অনেক পর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসায় আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বস্তিতে প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ থাকায় আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়।

রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বস্তিটা অনেক বড় এলাকা জুড়ে হওয়ায় আগুন লাগার কারণ তদন্ত সাপেক্ষে বলতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণে কাজ করেছে। ’ আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো পানির উৎস পাইনি। পুকুর, খাল বা অন্য কোনো উৎস না থাকায় নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে। তার পরও ফায়ার সার্ভিসের ২২ হাজার লিটারের পাঁচটি গাড়ি কাজ করেছে। ’

আগুন পরিস্থিতি দেখতে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে এটাই সঠিক তথ্য নয়। আগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া যাবে সেটা মূল। ’

অগ্নিকাণ্ডের পর পরিস্থিতি দেখতে ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় তিনি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকার জন্য এলাকাবাসীকে অনুরোধ জানান। মেয়র বলেন, ‘এই বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানোর কোনো কারণ নেই। যারা বস্তিতে থাকে তারাও মানুষ। যারা পাশে থাকে তারাও মানুষ। আগুন লাগার পর সব মানুষই আগুন নেভানোর জন্য চেষ্টা করেছে। ’ ঘরহারা বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বস্তিবাসীর জন্য আগে থেকেই বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় ফ্ল্যাট গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে বস্তিবাসীদের পর্যায়ক্রমে ফ্ল্যাটে তোলা হবে। এখন তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করাই মূল কাজ। সিটি করপোরেশন থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। ’

আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের নিজের সাধ্যমতো সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্। রাতে আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমার যতটুকু সাধ্য আছে, যতটা সম্ভব সহায়তা করব। ’

গত রাতে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বস্তিতে থাকা বেশির ভাগই ছিন্নমূল রিকশাচালক। বস্তিতে বেশির ভাগই টিন, বাঁশের খুঁটি, বাঁশের চাটাইয়ের ঘর থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের ভুক্তভোগী আবু তাহের ভেজা চোখে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগুনে সব হারাইছি। কোনো মতে জানটা নিয়া ভাইগ্গা আইছি। ১৪ ঘরের (কক্ষ) মালিক জিতুর পাঁচটি ঘর (কক্ষ) নিয়া থাকতাম। এহন সব গেছে। ’

মুজিবর রহমান নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগুনে নিজে বাঁচলেও বাসার কিছু বাঁচাতে পারিনি। কিছু টাকা জমাইছিলাম, সব পুইড়া ছাই হইছে। ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে আছি, এমন আগুন আগে চোখে দেখি নাই। ’

স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করে বলে, ‘আগুন লাগাইছে যারা, গ্যাসের ব্যবসা করে তারা। বস্তির পাশে ছয়তলা বাড়ির মালিক মামুন, সুমন; পাশের বাসার বাবু, দুলালসহ অবৈধ গ্যাসের লাইন দিত। সেখান থেকেই আগুন লাগছে। ’

আগুন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তা

মিরপুর-৭ সেকশনের মিল্ক ভিটা সড়কের পাশে ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে আটকে পড়াদের উদ্ধার, আহতদের চিকিৎসা, নিখোঁজদের খুঁজে পেতে সহযোগিতা এবং অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি কাজ করেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। ৫০ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম অগ্নিকাণ্ড শুরুর পরপরই ঘটনাস্থলে যায় এবং অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেছে বলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top