সেবা ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রথম মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, এমন নয়। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে ফেরার পর বারবার হত্যাকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি হাল ছাড়েনি। সেই আশির দশক থেকেই শেখ হাসিনার ওপর বারবার প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, অন্তত ১৯ বার। বিশ্বের আর কোনো রাজনৈতিক নেতা এতবার হামলার মুখে পড়েছেন বলে আমার জানা নেই। বিশ্বের আর কোনো নেতাও এভাবে বারবার বেঁচে যাওয়ার নজির নেই। শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার একটি অঘটনের আমি প্রত্যক্ষদর্শী। ২১ আগস্টের হত্যাচেষ্টার আগে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় হামলা।
ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম, ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ সাল, রোববার। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুকন্যা, ১৫ দলীয় জোটনেত্রী আসবেন ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে সর্বদলীয় ও পেশাজীবীদের এক জনসভায় ভাষণ দিতে। পুলিশ ঘোষণা দিল জনসভা হতে দেওয়া হবে না। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তানে ফেরত গিয়েছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় মুক্তমানুষ হিসেবে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে ১৭ জন অফিসারকে পুলিশ বাহিনীতে আত্তীকরণ করেন, তিনি তাদের অন্যতম। চেষ্টা করছেন চট্টগ্রামে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে যে কোনো উপায়ে দমন করতে। লালদীঘি ময়দানের আশপাশে ১৪৪ ধারা। সভাস্থল পুলিশ দিয়ে আগের রাতেই ঘিরে ফেলা হয়েছে, যাতে কোনো মঞ্চ তৈরি করা না হয়। ঠিক হলো, লালদীঘি পাড়ের জেলা পরিষদ সংলগ্ন মার্কেটের বারান্দা থেকে শেখ হাসিনা উপস্থিত জনসমাগমে বক্তব্য রাখবেন। নেত্রী দুপুর ১২টায় ঢাকা থেকে বিমানে এসে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামলেন। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল একটি খোলা ট্রাক। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসতে নেত্রী কয়েক জায়গায় পথসভায় বক্তৃতা দিলেন। পথের দু'পাশে হাজার হাজার মানুষ। শহরে প্রবেশ করতে করতে বিকেল ৪টা বেজে গেল। শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি কোতোয়ালি মোড় পার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের দিকে মোড় নিতেই হঠাৎ প্রথমে পেছনে থাকা পুলিশ শেখ হাসিনার ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এরপরই আদালত ভবনে ওঠার রাস্তার দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। সঙ্গে টিয়ার গ্যাস। দলের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে তার চারদিকে এক মানববর্ম তৈরি করেন।
লক্ষণীয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টেও নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেছিল। আসলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে শেখ হাসিনা কেবল ব্যক্তি নন। নিছক রাজনৈতিক নেতাও নন। তিনি দলটির প্রাণভোমরা। কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার। তাকে ঘিরেই পঁচাত্তরের পর বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু তথা বাংলাদেশবিরোধী শক্তির এত জিঘাংসা শেখ হাসিনার প্রতি। তাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে, শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা।
সেদিনের চট্টগ্রামে ফিরে যাই। গুলি আর টিয়ার গ্যাসের মধ্যেই আইনজীবীদের একটি মিছিল এসে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটিকে এস্কর্ট করে আদালত ভবনের দিকে নিয়ে যায়। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাকক্ষে তাকে ঘিরে থাকে সবাই। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল পুলিশের গুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশার ২৪ জন মানুষ লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। কয়েকজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশ সব লাশ নিয়ে যায় এবং সেই রাতেই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে অভয় মিত্র শ্মশানে তাদের দাহ করে ফেলা হয়। একটু সন্ধ্যা হয়ে এলে শেখ হাসিনাকে দলের নেতারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সার্সন রোডের বাসায় নিয়ে যান। রাতে চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ সড়কের বাতি বন্ধ, শহরজুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ। মাঝেমধ্যে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ আর পুলিশের গাড়ির টহল। পরদিন সকালে তার বাড়িতে নেত্রীর খোঁজখবর নিতে গেলাম। কিছু পর তিনি ওপর থেকে নিচে নেমে এলেন। ডেকে আমাকে পাশে বসিয়ে গতকালের ঘটনার বিবরণ জানতে চাইলেন। যতটুকু জানি তা তাকে জানালাম। তিনি জানতে চাইলেন, তিনি কী করতে পারেন। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, তিনি চট্টগ্রামে ওই মুহূর্তে মোটেও নিরাপদ নন। বললাম, প্রথম সুযোগেই তিনি যেন ঢাকায় চলে যান। বস্তুতপক্ষে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো একটি চতুর্মুখী ভয়াবহ আক্রমণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।
ওই হামলা এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হামলা- দুটিতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনোভাবে শেখ হাসিনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। এর কারণ হচ্ছে, শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে দেশে যে কোনো স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন সফল হতে বাধ্য। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আর এই দেশে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কোনো গণআন্দোলন সফল হয়নি। এটা ঠিক যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করে এ দেশের ছাত্র সমাজ। পরে যোগ দেয় পেশাজীবী সংগঠনগুলো আর বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট। কিন্তু সেই আন্দোলনের পালে ততক্ষণ হাওয়া লাগেনি, যতক্ষণ আওয়ামী লীগ তাতে যোগ দেয়নি। ২০০৪ সালেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বুঝতে পেরেছিল শেখ হাসিনা যতদিন আছে, বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারবে না তারা। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, স্বৈরশাসন পোক্ত করার স্বপ্ন কোনোদিন সফল হবে না। তাই তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার নিশানা করেছিল।
এই বড় দুটি হত্যা প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল; কারণ স্রষ্টার ইচ্ছা আর দলীয় নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগের কারণে। এই দুটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার একটি অর্থ হতে পারে, হয়তো আল্লাহ শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাকে দিয়ে কোনো একটা ভালো কাজ করাবেন বলে। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ আর সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। এখন আমরা দেখছি, তার নেতৃত্বেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। আর হত্যাকারী ও তাদের মদদদাতারা এখন ছিন্নভিন্ন ও বিপর্যস্ত। যেমন রাজনৈতিকভাবে, তেমনই সাংগঠনিকভাবে।
২৪ জানুয়ারি আর ২১ আগস্টের শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোক।
আবদুল মান্নান
শিক্ষাবিদ, বিশ্নেষক ও গবেষক
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।