হজ সফরে যেসব বরকতময় স্থান জিয়ারত করতে হয়!

S M Ashraful Azom
0
হজ সফরে যেসব বরকতময় স্থান জিয়ারত করতে হয়!
সেবা ডেস্ক: হজ করার সকল কার্যক্রম মক্কাতেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া মক্কায় রয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাবান মসজিদ। যেখানে নামাজ পড়লে অন্য মসজিদের তুলনায় এক লাখগুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে হয়ত আমরা সবাই সে মসজিদ চিনতে পেরেছি, সে মসজিদটি হচ্ছে মসজিদে হারাম।

তাই হাজি সাহেবদের মক্কার বাইরে যেতে হয় না। কিন্তু ইচ্ছে করলে হজের সফরে আমরা ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন নিদর্শন, যুদ্ধের ময়দান ও ঐতিহাসিক বস্তু দেখে আসতে পারি। ইসলামের সে নিদর্শনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাসি-কান্নার ইতিহাস। যা দেখলে মুমিনের ঈমান তাজা হবে। শানিত হবে দ্বীনি চেতনা। সেগুলো হচ্ছে-

মক্কায় জিয়ারতের স্থানগুলো-


গারে হেরা:

নবী করিম (সা.) এর ওপর প্রথম ওহি নাজিল হয় এই গুহাতে। বর্ণিত আছে যে, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) নবুওয়াত লাভের আগে আল্লাহ তায়ালার ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য এই গুহাতে যেতেন। তিনি সঙ্গে করে কয়েক দিনের খাবার নিয়ে যেতেন। সে খাবার শেষ হলে কখনো ফিরে আসতেন আবার কখনো খাদিজা (রা.) প্রয়োজনীয় সামান সেখানে পৌঁছে দিতেন। কথিত আছে যে উক্ত গুহায় অনেক নবী ধ্যানে বসেছেন। রাসূল (সা.) এর দাদা খাজা আব্দুল মুতালিবও সেখানে ধ্যানে বসতেন। তাই উক্ত স্থানকে বরকতময় মনে করা হয়। সেখানে গিয়ে কেউ কেউ নফল নামাজ আদায় করেন। কোরআন তেলাওয়াতও করেন অনেকে।

গারে ছাওর: 

হিজরতের সময় নবী করিম (সা.) মক্কা থেকে বের হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নেন। সঙ্গে ছিলেন প্রিয় সহচর হজরত আবু বকর (রা.)। আল কোরআনে এই গুহা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ করুন ওই সময়ের কথা যখন তাঁরা দুজন ছিলো গুহায় এবং তিনি তার সহচরকে বললেন পেরেশান হয়ো না নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ উক্ত আয়াতে যে গুহার আলোচনা হয়েছে তা হচ্ছে গারে ছাওর। এখানে তিন দিন অবস্থানের পর নবী করীম (সা.) মদিনার পথে রওয়ানা হন।

জাবালে আবু ক্বুবাইস: 

হজরত মুজাহিদ (রাহ.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায় আল্লাহ তায়ালা জমিনের ওপর সর্বপ্রথম পাহাড় এই জাবালে কুবাইসকে রেখে ছিলেন। কথিত আছে যে, বিখ্যাত চন্দ্র দু,টুকরো করার ঘটনা এই পাহাড়েই সংঘটিত হয়েছিল।

জান্নাতুল মুআল্লা কবরস্থান:

জান্নাতুল মুআল্লাহ মক্কার কবরস্থানের নাম। দুনিয়ার বুকে জান্নাতুল বাকির পরেই এই কবরস্থানের মর্যাদা। এই কবরস্থানকে জিয়ারত করা মুস্তাহাব। সেখানে অনেক সাহাবা, তাবিয়ীন ও বুযূর্গ শুয়ে আছেন। তাই পূর্ণ আদবের সঙ্গে কবর জিয়ারত করতে হবে।

মক্কার আশপাশে জিয়ারত করার মতো কিছু মসজিদ-

(এক) রায়া মসজিদ বা মসজিদে রায়া। রায়া শব্দটি আরবি রায়েতুন থেকে। রায়েতুন অর্থ হচ্ছে ঝাণ্ডা। মক্কা বিজয়ের দিন নবী করিম (সা.) ওই মসজিদের জায়গায় ঝাণ্ডা গেড়েছিলেন। তাই মসজিদটি নির্মানের পর নাম রাখা হয়েছে মসজিদে রায়া। উক্ত মসজিদটি জান্নাতুল মুয়াল্লার কবরস্থানে যাওয়ার রাস্তায় বিদ্যমান।

(দুই) মসজিদে জ্বিন বা জিনের মসজিদ। যেখানে উপস্থিত হয়ে জ্বিনেরা রাসূল (সা.) এর কোরআন তেলাওয়াত শুনেছিলেন সেখানে পরবর্তীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এটাই এখন বিখ্যাত মসজিদে জ্বিন।

মদীনায় যে সকল স্থানে জিয়ারতের জন্য যাওয়া যায়-


উহুদ পাহাড়:

মদিনা থেকে আনুমানিক তিন মাইল দূরে অবস্থিত উহুদ পাহাড়। ওই পাহাড়ের দিকে ইশারা করে নবী করীম (সা.) বলতেন ‘উহুদ ওই পাহাড় যে আমাদের মহব্বত করে এবং আমরাও তাকে মহব্বত করি।’ তৃতীয় হিজরিতে এখানে ঐতিহাসিক উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই যুদ্ধে সত্তরজন সাহাবি যাদের মধ্যে রাসূল (সা.) এর প্রিয় চাচা হামযা (রা.)ও ছিলেন মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। হজরত হামযা ও মদিনার শিক্ষক হিসেবে খ্যাত হজরত মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-সহ প্রায় সত্তরজন শহিদের কবর সেখানে রয়েছ। প্রসিদ্ধ আছে যে, হজরত হারুন (আ.) এর কবরও সেই উহুদের প্রান্তরেই নাকি বিদ্যমান।

জান্নাতুল বাকীতে কবর জিয়ারত:

পূর্বে আলোচনা হয়েছে মক্কায় একটি কবরস্থান আছে যাকে জান্নাতুল মুআল্লা বলা হয়। মদিনাতেও ওইরূপ একটি কবর আছে যাকে জান্নাতুল বাকী বলে। কবরস্থান হিসেবে দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবরস্থান। দুনিয়ার বহু আবেদ বুযূর্গের দিলের তাম্মান্না ছিলো এখানে কবরস্থ হওয়ার। কিন্তু সকলের ভাগ্যেই তা জুটে না। বরং তাদের নসিবেই তা জুটে যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন। এই সৌভাগ্য লাভের আশায় অনেক বড় বড় আলেম জীবনসাঙ্গে এসে মদিনাতে পাড়ি জমিয়েছেন। হাদিসের কিতাবগুলোতে এসেছে শবে বরাতের রাতে রাসূল (সা.) জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া করতেন। সেখানে হজরত উসমান (রা.), রাসূল (সা.) এর পুত্র সন্তান হজরত ইব্রাহিম (রা.) ও স্ত্রীগণের মাঝে হজরত খাদিজা ও মাইমুনা (রা.) ছাড়া বাকী সকলের কবর রয়েছে। তাদের ছাড়াও আরো বহু সাহাবায়ে কেরামের কবর সেখানে রয়েছে। রাসূল (সা.) এর চাচা ও অন্যতম মুরব্বি হজরত আব্বাস (রা.) এর কবরও জান্নাতুল বাকীতে রয়েছ। উলামায়ে কেরামের অভিমত হচ্ছে হজরত আব্বাস (রা.) এর কবর জিয়ারত দ্বারা শুরু করা। সম্মান ও শুরুতে হওয়ার দিকে লক্ষ করে।

মসজিদে কুবা:

মসজিদে কুবা হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম মসজিদ। মসজিদে নববী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে পশ্চিম দিকে। মক্কা থেকে হিজরতের পর রাসূল (সা.) বনু আওফ গোত্রে অবস্থানের সময় সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে এই মসজিদ নির্মান করেন। মসজিদে হারাম, নববী মসজিদ ও মসজিদের আকসার পর দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ হচ্ছে কুবার মসজিদ। উক্ত মসজিদে নফল নামাজ অনেক ফজিলতের বিষয়। বলা হয় কুবা মসজিদে দুই রাকাত নামাজ সওয়াবের দিক থেকে ওমরার সমান।

মসজিদে কিবলাতাইন: 

রাসূল (সা.) মদিনায় যাওয়ার পর আনুমানিক ষোল মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ পড়েন। রাসূল (সা.) এর মনের আকাঙ্খা ছিলো মক্কার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা। তাই তিনি বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন, কখন কিবলা পরিবর্তনের ওহি নাজিল হয়। এই অবস্থায় রাসূল (সা.) একদিন জোহরের নামাজ পড়াচ্ছিলেন উক্ত মসজিদে আর তখনি কিবলা পরিবর্তনের বিধান নাজিল হয়। রাসূল (সা.) সকল মুসল্লিসহ বাইতুল্লাহর দিকে ফিরে বাকি নামাজ শেষ করেন। যেহেতু উক্ত মসজিদে দুটি কেবলার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা হয়েছে তাই তাকে মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ বলা হয়।

মসজিদে বনি সালেম বিন আওফ:

রাসূল (সা.) হিজরত করে মদিনার এরিয়ায় পৌছার পর যখন বনু সালেম বিন আওফ গোত্রের এলাকায় এলেন তখন জুমার নামাজের সময় হয়ে যায় আর রাসূল (সা.) ওই গোত্রের মসজিদেই প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। ওই মসজিদটি ‘মসজিদে বনু সালেম বিন আওফ’ হিসেবে বিখ্যাত। এখানেই সর্ব প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়।

মসজিদে বনি কুরইজা: 

ইহুদী গোত্র বনি কুরইজার সঙ্গে যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) যেখানে অবস্থান করেছিলেন সেখানেই ওই মসজিদটি রয়েছে। আনসারদের নেতা হজরত সাআদ ইবনে মুআজকে ওই মসজিদেই ইহুদীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছিলো। সেখানেই তিনি রায় দিয়েছিলেন যে, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদেরকে হত্যা করা হবে এবং বাচ্চা ও মহিলাদেরকে বন্দি করা হবে।
মক্কা ও মদিনার বাইরে জিয়ারতের স্থান সমূহ

মসজিদে বদর:

ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বদরের ময়দান। দীর্ঘ দিন নির্যাতন সহ্য করার পর যখন বাধ্য হয়ে মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করলেন সেখানেও মক্কার মুশরিকদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। থাই রাসূল (সা.) চাইলেন মক্কার মুশরিকদের শক্তির মূল উৎস অর্থনৈতিক জায়গাটাকে দুর্বল করে দিতে। তাই দ্বিতীয় হিজরিতে রাসূল (সা.) মক্কার মুশরিকদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে ধাওয়া করতে গিয়ে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। বদর দিবসে আল্লাহ তায়ালা হক বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই যুদ্ধের পর মুসলমানদের মনোবল পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। বদর যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সাহাবায়ে কেরামের মাজার সেখানে রয়েছে। তাই সম্ভব হলে বদর প্রান্তর ঘুরে আসা। ইনশাআল্লাহ ইমান জিন্দাহ হবে।

হুদাইবিয়া:

মক্কা থেকে নয় মাইল দূরে হুদাইবিয়া অবস্থিত। ষষ্ট হিজরিতে রাসূল (সা.) তার সহচরবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে কাবা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। উট হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে বসে পড়ে। রাসূল (সা.) বলেন, এই উট আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। এরপর বিশেষ কিছু পয়গাম দিয়ে হজরত উসমান (রা.)-কে মক্কায় প্রেরণ করা হয়। হঠাৎ সংবাদ আসে হজরত উসমান (রা.)-কে শহিদ করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) হত্যার বদলা নেয়ার জন্য সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে আমৃত্যু লড়াইয়ের বাইআত নেন। আল কোরআনে ওই বাইআতকে ‘বাইআতে রিজওয়ান’ বলা হয়েছে।
পরে সংবাদ মিথ্যা বলে প্রমাণীত হয় এবং কুরায়িশদের পক্ষ থেকে সন্ধির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য দূত পাঠানো হয়। কিছু শর্ত মেনে মুসলমানরা মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে দশ বছরের সন্ধিতে আবদ্ধ হন। ইতিহাসে তা ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ হিসেবে খ্যাত। যে গাছের নিচে বাইআত নেয়া হয়েছিলো সাহাবায়ে কেরামদের অনেকে তার নিচে পরবর্তীতে বসেছেন। বরকতের আশায় হুদাইবিয়া জিয়ারতে যাওয়া যায়।

খাইবার:

মদিনা থেকে আনুমানিক ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর। মদিনা থেকে ইহুদিরা বিতাড়িত হওয়ার পর খাইবারে এসে আশ্রয় নেয়। ইহুদি জাতি ষড়যন্ত্রে সর্বকালেই সেরা। খাইবারে বসে ওরা মদিনার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ইতোমধ্যে তাদের উসকানিতে কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। তাই রাসূল (সা.) চাইলেন ওদেরকে শায়েস্তা করতে। সপ্তম হিজরিতে রাসূল (সা.) খাইবার আক্রমন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ ছিলো।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top