আরিফ উর রহমান টগর, টাঙ্গাইল: আজ ১৭ নভেম্বর। ১৯৭৬ সালের এ দিনে পরলোক গমন করেন মজলুম জননেতা মওলানা আুবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের মজলুম রাজনৈতিক ইতিহাস আর আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। এ মৃত্যুতেই মজলুম মানুষেরা চিরতরে হারায় তাদের পক্ষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর । আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ধর্মীয় নেতা আর সার্বজনীন রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন একজন স্ব-শিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁর জীবনযাপন ছিল সাদাসিধে। তাঁর রাজনীতি আর নেতৃত্বেই ছিল কৃষক, শ্রমিক আর সাধারণ মানুষ, যাদের অধিকার আর স্বার্থ রক্ষার্থেই ছিল তার আজীবন সংগ্রাম। এছাড়াও ব্যক্তি ক্ষমতায় কোন মোহ ছিল না তাঁর ।
পরিচয় ঃ ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভাসানী। তাঁর পিতা হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যায়ন ব্যতিত বিশেষ কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর। এরপরও তিনি কর্মজীবন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
মওলানা হামিদ খান হলেন ভাসানীর রাজনৈতিক আর্বিভাব ঃ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে এসে তৎকালীন অত্যাচারিত কৃষকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে তিনি আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের স্বার্থরক্ষায় শুরু করেন আন্দোলন। ওই এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে বন্যার কবল থেকে বাঙালি কৃষকদের রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানচরের জনসাধারণ তাকে ‘ভাসানী সাহেব’ বলে অভিহিত করেন এবং পরবর্তীতে এই উপাধি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
আন্দোলন আর কারাগারে রাজনৈতিক জীবন ঃ ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করে আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তবে ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতার ফলে আসামের মুখ্যমনী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহ্র সঙ্গে মওলানা ভাসানীর সংঘর্ষ বাঁধে। ভারত বিভাগের তৎকালীন সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আসাম সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আসাম ছাড়ার শর্তে তাকে মুক্তি দেয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাসানী পূর্ব বাংলায় আসেন, তবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব থেকে তাকে দূরে রাখা হয়। তিনি দক্ষিণ টাঙ্গাইল এলাকার উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী হয়ে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন। তবে একটি অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও সকল প্রার্থীকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৯ সালে পন্নীর ওপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও ভাসানীর ওপর থেকেই যায়। ১৯৪৯ সালে ভাসানী পুনরায় আসাম যান। সেখানে তিনি গ্রেফতার হয়ে ধুবড়ি জেলে যান। মুক্তি পেয়ে পূনরায় তিনি ঢাকায় আসেন। মুসলিম লীগের ক্ষুব্ধ সদস্যরা ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন এক কর্মী সম্মেলনের ডাক দেন। প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩’শ প্রতিনিধি যোগদান করেন ওই সম্মেলনে। ২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের নতুন রাজনৈতিক দলের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী আর টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। জন্মদিনে নতুন দলটি ঢাকার আরমানিটোলায় ভাসানীর সভাপতিত্বে এক জনসভার আয়োজন করে। এখানেও ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তির পর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহতের প্রতিবাদ করায় ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুণরায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন। ১৯৫৪ সালের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি হন। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন ভাসানী। এই মতবিরোধের কারণে দলে ভাঙন ভাঙন শুরু হয়। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন তিনি। তিনি এই দলেরও সভাপতি এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানীকে আবার আটক করা হয়। ১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা চীন ভ্রমণে যান এবং ১৯৬৪ সালে হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব সমাজতন্ত্র সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপও ভাগ হয় এবং মওলানা চীনপ্রন্থী দলের নেতৃত্বে থাকেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাকে মুক্তির জন্য চাপ দিতে থাকেন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইয়াাহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মওলানা নির্বাচন বয়কট করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতের দিল্লিতে আটক হন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর মওলানা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্দ্ধগতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ছয়টি দল নিয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি যুক্তফন্ট গঠন করা হয়। ৩০ জুন মওলানাকে গ্রেফতার দেখিয়ে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী রাখা হয়। মওলানা ভাসানী ফারাক্কা চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখের লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খিদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সন্তোষে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
ভাসানীর কৃর্তি ঃ তিনি সন্তোষে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেয়েদের একটি স্কুল এবং একটি শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি পাঁচবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আসামে তিনি ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সন্তোষে সমাহিত করা হয়।
৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ঃ যথাযোগ্য মর্যাদায় মওলানা হামিদ খান ভাসানীর বিগত মৃত্যুবার্ষিকী পালন হয়ে আসছে। আজ শনিবার ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগন আজ আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার অবিসংবাদিত নেতার মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আলাউদ্দিন এর সকাল সাড়ে ৭টায় মাওলানা ভাসানীর মাজারে পুস্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসুচি শুরু হবে। এরপর সংসদ সদস্য মোঃ ছানোয়ার হোসেন ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুকের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মাওলানা ভাসানীর পরিবার, মির্জা ফখরুল ইসলামে নেতৃত্বে বিএনপি, জেলা জাতীয় পার্টি ও টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দেশী বিদেশী অসংখ্য ভক্ত মুরিদান ও সর্বস্তরের জনতা মরহুমের মাজারে পুস্পস্তবকক অর্পন করে শ্রদ্বা নিবেদন করেন।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, ওরশ, গন ভোজসহ দিন ব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মাওলানা ভাসানীর আপোসহীন ভূমিকা কে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্বার সাথে স্মরন করবেন। ইতোমধ্যেই তাঁর ৪২তম মৃত্যু বার্ষিকী পালনের সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
⇘সংবাদদাতা: আরিফ উর রহমান টগর
পরিচয় ঃ ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভাসানী। তাঁর পিতা হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যায়ন ব্যতিত বিশেষ কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর। এরপরও তিনি কর্মজীবন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকার কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
মওলানা হামিদ খান হলেন ভাসানীর রাজনৈতিক আর্বিভাব ঃ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে এসে তৎকালীন অত্যাচারিত কৃষকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে তিনি আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের স্বার্থরক্ষায় শুরু করেন আন্দোলন। ওই এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে বন্যার কবল থেকে বাঙালি কৃষকদের রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানচরের জনসাধারণ তাকে ‘ভাসানী সাহেব’ বলে অভিহিত করেন এবং পরবর্তীতে এই উপাধি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
আন্দোলন আর কারাগারে রাজনৈতিক জীবন ঃ ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করে আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তবে ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতার ফলে আসামের মুখ্যমনী স্যার মোহাম্মদ সাদউল্লাহ্র সঙ্গে মওলানা ভাসানীর সংঘর্ষ বাঁধে। ভারত বিভাগের তৎকালীন সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আসাম সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আসাম ছাড়ার শর্তে তাকে মুক্তি দেয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাসানী পূর্ব বাংলায় আসেন, তবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব থেকে তাকে দূরে রাখা হয়। তিনি দক্ষিণ টাঙ্গাইল এলাকার উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী হয়ে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন। তবে একটি অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও সকল প্রার্থীকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৯ সালে পন্নীর ওপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও ভাসানীর ওপর থেকেই যায়। ১৯৪৯ সালে ভাসানী পুনরায় আসাম যান। সেখানে তিনি গ্রেফতার হয়ে ধুবড়ি জেলে যান। মুক্তি পেয়ে পূনরায় তিনি ঢাকায় আসেন। মুসলিম লীগের ক্ষুব্ধ সদস্যরা ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন এক কর্মী সম্মেলনের ডাক দেন। প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩’শ প্রতিনিধি যোগদান করেন ওই সম্মেলনে। ২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের নতুন রাজনৈতিক দলের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী আর টাঙ্গাইলের শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। জন্মদিনে নতুন দলটি ঢাকার আরমানিটোলায় ভাসানীর সভাপতিত্বে এক জনসভার আয়োজন করে। এখানেও ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তির পর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহতের প্রতিবাদ করায় ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুণরায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন। ১৯৫৪ সালের মে দিবসে তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বৃহৎ শ্রমিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি হন। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন ভাসানী। এই মতবিরোধের কারণে দলে ভাঙন ভাঙন শুরু হয়। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন তিনি। তিনি এই দলেরও সভাপতি এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানীকে আবার আটক করা হয়। ১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা চীন ভ্রমণে যান এবং ১৯৬৪ সালে হাভানায় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব সমাজতন্ত্র সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপও ভাগ হয় এবং মওলানা চীনপ্রন্থী দলের নেতৃত্বে থাকেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং তাকে মুক্তির জন্য চাপ দিতে থাকেন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ইয়াাহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মওলানা নির্বাচন বয়কট করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতের দিল্লিতে আটক হন। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর মওলানা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্দ্ধগতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ছয়টি দল নিয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি যুক্তফন্ট গঠন করা হয়। ৩০ জুন মওলানাকে গ্রেফতার দেখিয়ে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী রাখা হয়। মওলানা ভাসানী ফারাক্কা চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখের লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খিদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সন্তোষে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
ভাসানীর কৃর্তি ঃ তিনি সন্তোষে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেয়েদের একটি স্কুল এবং একটি শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি পাঁচবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আসামে তিনি ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সন্তোষে সমাহিত করা হয়।
৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ঃ যথাযোগ্য মর্যাদায় মওলানা হামিদ খান ভাসানীর বিগত মৃত্যুবার্ষিকী পালন হয়ে আসছে। আজ শনিবার ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগন আজ আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার অবিসংবাদিত নেতার মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আলাউদ্দিন এর সকাল সাড়ে ৭টায় মাওলানা ভাসানীর মাজারে পুস্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসুচি শুরু হবে। এরপর সংসদ সদস্য মোঃ ছানোয়ার হোসেন ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুকের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মাওলানা ভাসানীর পরিবার, মির্জা ফখরুল ইসলামে নেতৃত্বে বিএনপি, জেলা জাতীয় পার্টি ও টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দেশী বিদেশী অসংখ্য ভক্ত মুরিদান ও সর্বস্তরের জনতা মরহুমের মাজারে পুস্পস্তবকক অর্পন করে শ্রদ্বা নিবেদন করেন।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, ওরশ, গন ভোজসহ দিন ব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মাওলানা ভাসানীর আপোসহীন ভূমিকা কে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্বার সাথে স্মরন করবেন। ইতোমধ্যেই তাঁর ৪২তম মৃত্যু বার্ষিকী পালনের সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
⇘সংবাদদাতা: আরিফ উর রহমান টগর
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।