সেবা ডেস্ক: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র নেত্রী ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আদালত কারাগারে স্থানান্তর করায় উঠে আসে কর্নেল তাহেরের ট্রায়ালের বিষয়টি। তবে রাজনীতিতে এমন হাস্যকর তুলনা রীতিমত নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইতিহাস ব্যবহার করে এমন নোংরা রাজনীতি আগামী দিনের গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। যেই প্রহসনের বিচার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি করেছিল, আজ তারাই সেই বিচারকে ‘উদাহরণ’ দিচ্ছে।
কর্নেল আবু তাহের ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯৬০ সালে। ওই বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১১ নম্বর সেক্টরের তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। পরবর্তী সময়ে ‘বীর উত্তম’ খেতাব পান। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন।
১৯৭৬ সালের ১৪ জুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় তাহেরের বিচারের জন্য। ১৭ জুলাই তাহেরকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাহেরকে যে আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সে আইনে ওই সময় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ’৭৬-এর ৩১ জুলাই মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। তাই আইনগতভাবে ওই দণ্ড ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই আদালতের বিচারক আবদুল আলী ও অন্যরা বলেছেন, বিচারের সময় তাদের সামনে কোনো কাগজ বা নথিপত্র ছিল না। এছাড়া আসামিরা জানতেন না যে তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ! তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিতে কোনো আইনজীবীও দেওয়া হয়নি। এসব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই বিচার সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী।
বিচার বিভাগ ও আইনকে তুচ্ছ করে তাহেরকে গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে দাঁড় করিয়ে আইনের শাসনকে উপহাস করার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন কুখ্যাত সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্যে দিয়ে সেই উপহাসকে দিয়েছেন নীতির মর্যাদা। পরে তিনিই নির্বাচন দিয়েছেন, সামরিক শাসন তুলে নিয়েছেন, কিন্তু এসবই করেছেন সামরিকতন্ত্রের তত্ত্বাবধানে সমমনোভাবাপন্ন শ্রেণি-অংশটিকে গুছিয়ে নিয়ে, ওই শ্রেণি-অংশের উপযোগী রাজনৈতিক দল গঠনের পরে। তাহের, যিনি কিনা ছিলেন কর্নেল, জিয়ার প্রহসনের পর আজ দেশপ্রেমের প্রতীক, আদর্শের প্রতিচ্ছবি।
তাহেরের কথা প্রাসঙ্গিক আকারে এখন দাঁড়ালো কেননা জিয়াউরের সেই বিএনপি এখন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার আদালত কারাগারে স্থানান্তর নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অনেকে আবার খালেদার বিচারের সাথে কর্নেল তাহেরের বিচারের সাদৃশ্য খুঁজছেন। আজকের এই দিনে এমন তুলনা রীতিমত হাস্যকর- তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই কারাগারে আদালত বসানো হয়েছে। এটা ক্যামেরা ট্রায়াল নয়। পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ এবং বিশ্লেষণী উপাদানের আলোকে খালেদার অভিযোগ প্রমাণিত এবং সর্বজনবিদিত।
আইনমন্ত্রী প্রসঙ্গত বলেন, “একটা কথা উঠেছে, এটা ক্যামেরা ট্রায়াল। ক্যামেরা ট্রায়ালের সংজ্ঞা হচ্ছে, যেখানে কাউকে কোনো ‘পাবলিক বা মিডিয়া’ প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। যেখানে শুধু বিচারক, আসামি আর প্রয়োজন হলে তার আইনজীবীকে রাখা হয়। এমন যদি হয়, তাহলে ক্যামেরা ট্রায়াল হয়। কিন্তু সাত মাস যাবৎ এই আদালত বসছে। নিরাপত্তার কারণে বা অন্য কোনো কারণে তিনি যখন হাজিরা দিচ্ছেন না, তখন সেটার সুবিধার্থে নিরাপত্তা আরও সুনিশ্চিত করার জন্য সেখানে আদালত বসানো হয়েছে। এতে কারও অধিকার খর্ব করা হয়নি।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আইন মেনেই কারাগারে অস্থায়ী আদালত গঠন করা হয়েছে। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে এমন বক্তব্য আদালতের প্রতি অনাস্থা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কোনো মামলা বিচারের জন্য কোনো স্থানকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করা নতুন নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিচার যখন হয়, তখন পুরোনো কারাগারের একটি অংশকে আদালত করা হয়েছিল’।
রাজনীতিতে ঘটনা বা কথার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির অতীতভোলা রাজনীতি তাদের নিজেদেরই ক্ষতি বয়ে আনছে। এমন নেতিবাচক রাজনীতি ছেড়ে বিএনপি জনমানুষের সাথে হাত মেলাবে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।