মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে একটিভ গার্ডিয়ান ফোরামের ভুমিকা অন্যতম

S M Ashraful Azom
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে একটিভ গার্ডিয়ান ফোরামের ভুমিকা অন্যতম
গত এক দশকে বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় ৯৬.৭% । এমডিজি অর্জনে এই সাফল্যের জন্য জাতীয়সংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের জন্য “রোল মডেল’ ঘোষনা করেছেন। 

বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় ২০১৬-২০৩০ সাল মেয়াদে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা বিষয়ে এসডিজিতে (লক্ষ্যমাত্রা-৪) মানসম্মত শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের শিক্ষার মূল ভিত্তি । তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব আরোপ করেছে। 

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যেগ হল Parents Teachers Association বা শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি। কিন্তু এই সমিতি নানা কারণে তার কাঙ্খিত ভুমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই সমিতির একটি র্কাযকর বিকল্প হিসেবে বর্তমান লেখকের একটি সৃজনশীল উদ্যোগ একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম শাহরাস্তি উপজেলার কিছু স্কুলে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ।


মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, ভৌত অবকাঠামোর পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষক তৈরী, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং প্রাথমিক শিক্ষার দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সর্বাধিক। বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় দেশে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। 

পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকার বেশকিছু কৌশলগত নীতি এবং উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন। যেমন- যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করে বই উৎসব পালন, শিক্ষার্থীদেরকে উপবৃত্তি প্রদান, SLIP বরাদ্দ থেকে দরিদ্র শিশুদের জন্য পোশাক, খাতা-কলমের ব্যবস্থা, উদ্ভাবনী বিভিন্ন কার্য়ক্রমের মাধ্যমে প্রাথমকি শিক্ষার উদ্ভুদ সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্ঠা, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মা সমাবশে, হোম ভিজিট করে উপস্থিতি বৃদ্ধি, মানসম্মত পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রাক-প্রাথমিক কক্ষ সুসজ্জতিকরণ প্রভৃতি বহুমুখী উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়েছে । 

 কিন্তু শিক্ষক-অভিভাবক-স্কুল কমিটির মধ্যে সমন্বয় না থাকা এবং যথাযথ তদারকির অভাবে মানসম্মত প্রাথমকি শিক্ষা নিশ্চিত করা চ্যালঞ্জে হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অভিভাভকদের অংশগ্রহনের জন্যই এসএমসির পাশাপাশি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই আশির দশকেই প্রত্যেক স্কুলে একটি করে Parents Teacher Association বা শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা, জবাবদিহিতা, সামাজিক সম্পৃক্ততা প্রভৃতির সাথে শিক্ষক-অভিভাকদেরকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্যালয়কে একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রূপদানের জন্য এই শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি গঠণ করা হয়েছে। ১০ সদস্যবিশিষ্ঠ এই কমিটিতে মাত্র দুই জন শিক্ষককে রাখা হয়েছে। বাকী সবাই অভিভাবক হতে নির্বাচিত হয়ে থাকে।


যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তিন দশক পূর্বে শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি গঠিত হয়েছিল বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে শিক্ষক-অভিভাবক সমিতির কর্মকান্ড স্থিমিত এবং কিছু বিদ্যালয়ে এর অস্থিত্ব নেই বললেই চলে। মাঠপ্রশাসনে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কিছু স্কুলে কাগজে -কলমে এর অস্থিত্ব থাকলেও বাস্তবে তেমন ভুমিকা চোখে পড়েনা। 

আবার কোন কোন স্কুলে অভিভাবগণ এমনকি স্কুলের শিক্ষকগণও এই সমিতি সম্পর্কে অবহিত নন। অথচ একথা শিক্ষাসংশ্লিষ্ঠ সকলেই জানেন যে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী এই তিন পক্ষেরই ভুমিকা পালন জরুরী। এ বিষয়ে সরেজমিন শিক্ষক-অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময়, বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই এবং পর্যালোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সমিতির ব্যর্থতার যে সমস্ত কারণ উঠে এসেছে তা নিম্নরূপ:

০১. এই সমিতির কার্য়পরিধি বেশী: এই সমিতির কার্যপরিধি অনেক বড়। ফলে ইহার বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে দাড়ায়। যেমন- স্কুলের শিশু জরিপ কাজে সহায়তা, স্কুলের সম্পদ রক্ষা থেকে শুরু করে মানবিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মুল্যবোধ রক্ষা, শিক্ষার্থীকে সমবায় কাজে উতসাহিত করা, শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতাকে জীবিকার উন্নয়নে সহায়তা করা প্রভৃতি । পর্যাপ্ত প্রেষনা ও আর্থিক এখতিয়ার ছাড়া এতগুলো কাজ করা প্রায় অসম্ভব প্রতীয়মান হয়।


০২. প্রতিটি স্কুলে সরকার নির্ধারিত নানা রকম কমিটি রয়েছে। প্রধানশিক্ষক শ্রেণি পাঠদানের পাশাপাশি এতগুলো কমিটির সমন্বয় করা কঠিন।

০৩. একটি স্কুলে কেন্দ্রীয়ভাবে সব ক্লাশের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সমন্বয়ে একটি শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি গঠিত হয়। অন্যান্য অনেক কমিটির মতই অভিভাবকগণ তাদের নিজ সন্তানের শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে মতামত দেয়ার সুযোগ থাকেনা বিধায় তারা এই কমিটির সভায় উপস্থিত হতে উৎসাহ বোধ করেন না ।

০৪. স্কুল পরিচালনা কমিটির অনাগ্রহ এবং অসহযোগিতা : বর্তমানে স্কুল পরিচালনা কমিটিগুলো গঠিত হয় স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায়। ফলে স্কুল কমিটির সদস্যগণ প্রায়শ: এটাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করে থাকেন। স্কুলের উন্নয়নে অন্যদের সম্পৃক্ততা কমিটির সদস্যগণ পছন্দ করেননা।


০৫. অভিভাবকদের অসচেতনতা: উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে অধিকাংশ অভিভাবক কম শিক্ষিত কিংবা অসচেতন। ফলে তারা সময় ও অর্থ ব্যয় করে এধরনের সমিতির কার্যক্রমে কোন উৎসাহবোধ করেননা।

০৬. আর্থিক কোন বরাদ্দ না থাকা : এই কমিঠির অনেকগুলো কাজ দেয়া হলেও কোনরূপ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়না । ফলে কমিটির সদস্যগণ কোনরূপ কাজ করতে আগ্রহী হয়না।
শিক্ষক-অভিভাবক সমিতির এতসব অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান লেখক এই সমিতির একটি কার্যকর বিকল্প অনুসন্ধান করতে সচেষ্ঠ হই। এজন্য এই সমিতির ইতিবাচক দিক, উচ্চশিক্ষাসূত্রে লেখকের অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালিন উন্নত দেশে প্রচলিত শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে সমন্বয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি অবলোকন এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন বেসরকারী নামকরা স্কুলে প্রচলিত পদ্ধতির সমন্বয়ে সৃজনশীল একটি পদ্ধতি-একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম: (ACTIVE GUARDIAN FORUM) প্রবর্তন করা হয়। কোনরুপ বাড়তি খরচবিহীন এই পদ্ধতি প্রবর্তনে সময় এর ব্যবহার উপযোগিতা, স্বল্পশিক্ষিত অভিভাবকগণ কর্তৃক এর ব্যবহার সক্ষমতা, শিক্ষক-অভিভাবকদের আগ্রহ প্রভৃতি বিবেচনায় নেয়া হয়।


একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম: (ACTIVE GUARDIAN FORUM) কি?

একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম একটি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারভিত্তিক অভিভাবক ফোরাম। ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জারেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেনিভিত্তিক একটি অভিভাবক ফোরাম গঠন করা হয়। বিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, সেবার মানোন্নয়ন এবং অভিভাবকদের সন্তানের সুশিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য বিষয়ে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালনের নিমিত্ত এটি গঠন করা হয়। । স্কুলের ’ডিজিটাল ক্যাম্পাস’ গঠনে অনন্য ভুমিকা পালনকারী এই ফোরামের মাধ্যমে অভিভাবক এবং শিক্ষকমন্ডলী প্রতিনিয়ত পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজ নিজ সন্তানের শিক্ষা এবং স্কুলের শিক্ষার মানোন্নয়নে ভুমিকা রাখছে।

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের দরুন দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি ৭২ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তৈরী হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী সকল স্কুলের অভিভাবকদের একটি বড় অংশ বা তাদের পরিবারের কেউ না কেউ মোবাইলে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। তারা ম্যাসেন্জার ফোরামে যুক্ত হয়ে তাদের সন্তান বা নিকটাত্মীয়ের শিক্ষা বিষয়ে সার্বক্ষনিকভাবে শিক্ষক, অভিভাবক এবং পরিচালনা পরিষেদের সাথে মতবিনিময় করতে পারছেন। তারা যে কোন সময় যে কারো সাথে ব্যক্তিগতভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারছেন।


এই পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:

(১) একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম শ্রেনীভিত্তিক হওয়াতে একজন অভিভাবক তার সন্তানের শিক্ষা ও শিক্ষাসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় নিয়ে দফাভিত্তিক আলোচনা ও মতামত দিতে পারছেন। (২) যে কোন সময় যে কোন সদস্য তার প্রশ্ন, উত্তর কিংবা মতামত দিতে পারেন। অন্য শিক্ষক কিংবা অভিভাবকও তার সুবিধাজনক সময়ে উত্তর বা মতামত দিতে পারেন। (৩) স্কুলে এসে সভা করার জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়না। (৪) স্কুলের ’ডিজিটাল ক্যাম্পাস’ গঠনে অনন্য ভুমিকা রাখতে পারে এই ফোরাম। (৫) এখানে কোন কমিটি নেই । নেই কোন পদবী। ফলে প্রভাব বিস্তার কিংবা লাভজনক কোন সুযোগ নেই এখানে। (৬) একজন অভিভাবক একান্তই তার সন্তানের বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। ফলে অভিভাবকগণ নিজ স্বার্থেই এই ফোরামে যুক্ত হয়ে সক্রিয় থাকছেন। নিজের স্বার্থ জড়িত থাকায় তারা খুব আগ্রহ নিয়ে এখানে যুক্ত থাকছেন। (৭) অনেক শিক্ষার্থীর মাতা-পিতা হয়ত ফেসবুক ব্যবহার করেন না । সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বড় ভাই-বোন কিংবা চাচা-মামা বা অন্য কেউ ফোরামে যুক্ত হয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সংক্রান্ত নানা তথ্য অভিভাবকের কাছে দিতে পারছেন। (৭) শ্রেণি শিক্ষক এই ফোরামটির এডমিন ও মডারেটর হিসেবে কাজ করে থাকেন। ফলে প্রধান শিক্ষকের উপর অনেকগুলো কমিটি সমন্বয় করার চাপ কমবে (৮) এটি একটি সাধারন প্লাটফরম। ফলে যে কেউ এখানে এডমিনের সম্মতিসাপেক্ষে যুক্ত হতে পারেন। আবার চাইলে ত্যাগ করে চলে যেতে পারেন।

মোটকথা, স্কুলের ’ডিজিটাল ক্যাম্পাস’ গঠনে অনন্য ভুমিকা পালনকারী ম্যাসেন্জার ভিত্তিক শিক্ষক ও অভিভাবক সমিতি- একটিভ গার্ডিয়ান ফোরাম এর মাধ্যমে অভিভাবক এবং শিক্ষকমন্ডলী প্রতিনিয়ত পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজ নিজ সন্তানের শিক্ষা এবং স্কুলের শিক্ষার মানোন্নয়নে ভুমিকা রাখছে।




লেখক
মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ (মারুফ)
উপজেলা  নির্বাহী অফিসার,
শাহরাস্তি , চাদঁপুর।







⦽প্রকাশকাল: ১৭-সেপ্টেম্বর-২০১৮-০১:৩৩  ⇘সংবাদদাতা: সেবা ডেস্ক

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top