চন্দনা মজুমদার গান ধরলেন ‘মানুষ ছেড়ে খেপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। হেমন্তের সন্ধ্যায় বাউল সম্রাট লালন ফকিরের এই গান উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মনে করিয়ে দিল, মানুষই সব, মানুষের জন্যই সব। মানুষকে বাদ দিয়ে কিছু না। লোকসঙ্গীত এভাবেই দেশে দেশে, যুগে যুগে মাটি থেকে, জীবন থেকে উত্সারিত উপলব্ধিতে সুর চড়িয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দেশে প্রথমবারের মত শুরু হলো আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উত্সব। আর্মি স্টেডিয়ামে হেমন্তের কুয়াশার মাঝে লোকসঙ্গীতের আসরে মানুষ যেন নিজের শেকড়ের গানের টানে ছুটে এসেছিলেন। যে গান আমাদের অস্তিত্বে মিশে রয়েছে। মেরিল নিবেদিত তিনদিনব্যাপী ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উত্সব ২০১৫’ এর আয়োজন করেছে মাছরাঙ্গা টেলিভিশন এবং সান ইভেন্টস। এবারের উত্সবে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, চায়না, আয়ারল্যান্ডের খ্যাতিমান সব লোকসঙ্গীত শিল্পীরা। গতকাল প্রথম দিনে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
প্রকৃতি থেকেই সুর ও সঙ্গীতের উত্পত্তি। বিস্তীর্ণ চরাচর, ধু ধু মাঠ, ফসলের খেত, রাঙা ধুলোয় মোড়া মেঠো পথের পরতে পরতে মিশে আছে বাংলার গান। মিশে আছে এই বাংলার মানুষের মনে। শুধু বাংলা কেন পৃথিবীর সব দেশেই লোকসঙ্গীত মাটি থেকে উত্সারিত। মানুষের দৈনন্দিন জীবন, কাজের ব্যস্ততা, অবসর ও নির্জনতার অনুভূতি মিশে আছে লোকগানে। প্রতিটি দেশের লোকগান তাই মানুষের মনের গূঢ় অভিব্যক্তি, কষ্ট, বঞ্চনা, দ্রোহ ব্যক্ত করে চলে।
বাংলার সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত কি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? কিংবা হারিয়ে ফেলছে কি তার স্বকীয়তা? কিংবা ফিউশন সঙ্গীতের নামে লোকসঙ্গীতের যে পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণ হচ্ছে এটা কি ঠিক হচ্ছে? এই সব যুক্তি-তর্কই উড়ে গেলো লালন-সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন যখন গান ধরলেন। গানের বাণী যখন মানুষকে স্পর্শ করে তখন সব যুক্তি উড়ে যায়। ফরিদা পারভীন একে একে গাইলেন: আমি অপার হয়ে বসে আছি, মিলন হবে কতদিনে ও সময় গেলে সাধন হবে না। মাটির গন্ধমাখা সেই কণ্ঠ মানুষের মনকে উদ্বেল করে তুললো।
গতকাল উদ্বোধনী দিনে আর্মি স্টেডিয়ামে সঙ্গীতপিপাসু মানুষের ঢল নেমেছিল। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই প্রবেশ করেছেন উত্সবস্থলে। উত্সবের সূচনা হয় মিনু হক ও পল্লবী ড্যান্স গ্রুপের অসাধারণ নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে। উত্সবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। উদ্বোধনী পর্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী ফেরদৌসী রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাছরাঙ্গা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, ‘লোকসঙ্গীতে এক ধরনের আন্তর্জাতিক সমতা রয়েছে।’ ফেরদৌসী রহমান বলেন, ‘লোকসঙ্গীত বাংলার গানের আদি ঠিকানা। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, জারি, সারি, মুর্শিদা, বিচ্ছেদী প্রভৃতি বাংলার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার অন্তরের গান। এই গানকে আমরা বড় অবহেলা করেছি। গণমাধ্যমগুলোতেও লোকসঙ্গীতের স্থান কমে গেছে। ফলে যারা গ্রামে এই লোকসঙ্গীতের চর্চা করেন তাদের সঙ্গে শহরের সঙ্গীতধারার যোগ ঘটছে না।’ অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রয়েছে। ‘ফোক ফেস্ট’ এর পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উত্সবও স্কয়ারই পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
উত্সবে অন্যান্যের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, ভারতের অর্ক মুখার্জী কালেক্টিভ, লাবিক কামাল গৌরব এর সঙ্গে রব ফকির এবং শফি মন্ডল, পাকিস্তানের সাঁই জহুর ও ভারতের পাপন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।