নবজাতক শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজন। একটি শিশু জন্মের পর থেকে দুই বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করতে পারে। কিন্তু প্রথম ছয় মাস শিশুর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেননা এ সময়ের মধ্যে শিশুর বর্ধন দ্রুত হয়। শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস যে পুষ্টির দরকার হয়, তার সব উপাদান মায়ের বুকের দুধেই বিদ্যমান। তাই শিশুর পরিপূর্ণ বর্ধন, বিকাশ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস শিশুকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং করাতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের মতে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের পূর্ব শর্ত হলো—
* জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে হবে।
* শিশুকে তার চাহিদা অনুযায়ী পূর্ণ ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে; অন্য কোনো খাবার কিংবা পানীয় দেওয়া যাবে না।
* শিশুর মুখে ফিডার কিংবা চুষনি দেওয়া যাবে না।
* আর এই ছয় মাস শিশুকে পানিও পান করানো যাবে না।
অনেকেই না বুঝে জন্ম হওয়ার সাথে সাথে শিশুকে মধু খাওয়ান। এতে করে নাকি শিশুটির কণ্ঠ সুমিষ্ট হবে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ভুল ধারণা। শিশু জন্মের পর ওই মধু হজম করার সামর্থ্যই অর্জন করে না। ফলে দেখা দেয় ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রিসহ নানা প্রকার হজমের গণ্ডগোল। এ কারণে কখনো কখনো সারাজীবন এই হজমের গণ্ডগোল থেকেই যায়। আরও একটি ভুল অনেকেই করে থাকেন, যা হলো—শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম সাত দিন মায়ের বুকের যে শাল দুধ (কোলোস্ট্রাম) নিঃসৃত হয়, তা শিশুকে পান না করিয়ে ফেলে দেন; কিন্তু এতে করে শিশুটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে তাকে মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে এবং শাল দুধ ফেলে দেওয়া যাবে না। কেননা এই শাল দুধে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলস, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু ছোটবেলায় মাতৃদুগ্ধ পান করেছে; তারা বড় হয়ে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে (যেমন—ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ ইত্যাদি) কম ভুগেছে। কেউ কেউ আবার ভালো মনে করেই শিশুকে ইচ্ছে করেই বাজারের গুঁড়া দুধ খেতে দিয়ে থাকেন; যা কোনো অবস্থাতেই মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারে না। মা যদি জীবিত থাকেন, আর কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় না ভোগেন তবে অবশ্যই মাতৃদুগ্ধ পান করানো উচিত। এতে করে শিশুও যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে, তেমনি মায়েরও কিছু উপকার হবে। যেমন—
* শিশু যতদিন বুকের দুধ খাবে ততদিন মায়ের পুনরায় গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে না।
* গর্ভকালীন মায়ের দৈহিক ওজন বেড়ে যায়, শিশুকে বুকের দুধ পান করালে সেই অতিরিক্ত ওজন কমে যায়।
* মা ও শিশুর আত্মিক বন্ধন সদৃঢ় হয়।
* গুঁড়া দুধ কিনে মায়ের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করারও প্রয়োজন হয় না।
কোনো কোনো মা মনে করেন, মাতৃদুগ্ধ পান করালে দৈহিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যাবে। আর তাই জন্মের পর থেকেই শিশুকে ফিডারে করে দুধ পান করান। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ঘটে উল্টো; বরং ব্রেস্ট ফিডিং করালেই বডি ফ্রেম আবারও আগের মতো হবে।
মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে; তাহলে কর্মজীবী মায়েরা কী করবেন? কর্মজীবী নারীদের জন্য পরামর্শ হলো; তারা অফিসে যাওয়ার আগে ব্রেস্ট পাম্পারের সাহায্যে দুধ বের করে রেখে যেতে পারেন; সাধারণ তাপমাত্রায় ছয়-আট ঘণ্টা পর্যন্ত তা ভালো থাকে। সেক্ষেত্রে ফিডার ব্যবহার না করে বাটি ও চামচ দিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। আর যদি এ পদ্ধতি একান্তই ঝামেলা মনে হয় তবে ফিডার ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু তা অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে দশ মিনিট ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে। তা নাহলে শিশুর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আমাদের দেশে নবজাতক শিশুকে সুজি খাওয়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যার প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। শিশুর জন্ম থেকে ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। এই সময় শিশুর যে পুষ্টি ও শক্তি দরকার হয় তা মাতৃদুগ্ধে যথেষ্টই বিদ্যমান। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর শিশু পুষ্টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা। তাই শিশুকে সঠিক নিয়মে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর মাধ্যমে শিশুর সুস্থ, সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করুন।